Advertisement
০৭ মে ২০২৪

মনে হচ্ছে আয়ু বেড়ে গেল, বলছেন মোহনবাগান দাদু

সনি নর্ডির কর্নার বেলো রেজ্জাকের মাথা ছুঁয়ে বেঙ্গালুরুর জালে জড়িয়ে যেতেই শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। আর ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পরে সকলে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। শুরু হল সেলিব্রেশন। বসিরহাটের ট্যাঁটরা গ্রামের সত্তর ছুঁইছুঁই জয়দেব দাস যেন তখন সঞ্জয় সেন! ভাবখানা এমন, তাঁর কোচিংয়েই তেরো বছর পরে ফের ভারতসেরা সবুজ-মেরুন!

দলের সাফল্যে তখন চলছে মিষ্টি খাওয়ার পালা। —নিজস্ব চিত্র।

দলের সাফল্যে তখন চলছে মিষ্টি খাওয়ার পালা। —নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৫ ০২:৫৩
Share: Save:

সনি নর্ডির কর্নার বেলো রেজ্জাকের মাথা ছুঁয়ে বেঙ্গালুরুর জালে জড়িয়ে যেতেই শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। আর ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পরে সকলে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। শুরু হল সেলিব্রেশন। বসিরহাটের ট্যাঁটরা গ্রামের সত্তর ছুঁইছুঁই জয়দেব দাস যেন তখন সঞ্জয় সেন! ভাবখানা এমন, তাঁর কোচিংয়েই তেরো বছর পরে ফের ভারতসেরা সবুজ-মেরুন!
বলা বাহুল্য, জয়দেব মোহনবাগান অন্ত প্রাণ। বাড়ির রং সবুজ-মেরুন। দরজা-জানলার পর্দার রং সবুজ-মেরুন। বৃদ্ধের মনের রঙ-ই যে তাই, পাড়ার ছেলে-বুড়োও বিলক্ষণ জানেন। জয়দেবের পাড়ার নাম ‘মোহনবাগান দাদু’। প্রিয় দল জিতলে অকাতরে মিষ্টি বিলোন বলে ‘মিষ্টি দাদু’ নামটাও কম জনপ্রিয় নয়। এক চিলতে ঘরে জয়দেববাবুর বাস। দেওয়ালে আঁকা মোহনবাগানের প্রতীক পালতোলা নৌকা। নিজে কাপড়-জামা ইস্ত্রি করেন। স্ত্রীর মনোহারি দোকান। ছেলে বাস কনডাক্টর। সব মিলিয়ে রোজগার খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রিয় দল জিতলে তাঁর মতো দরাজ দিল লোক মেলা ভার।

কলকাতায় দলের খেলা থাকলেই পকেটে রুটি-গুড় নিয়ে নিয়মিত বেরিয়ে পড়তেন ময়দানের দিকে। বয়সের কারণে আগের মতো যেতে পারেন না। তবে এখনও শয়নে-স্বপনে মোহনবাগানই তাঁর একমাত্র নেশা। কয়েক বছর ধরে বাগানে বসন্ত না আসায় তাঁর নাকি শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল! তবে আই লিগ ঘরে আসতেই সেই তিনিই দিব্যি তাজা হয়ে উঠেছেন। ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রী পূর্ণিমাদেবী বলেন, ‘‘বিয়ের পর থেকেই দেখছি মোহনবাগানের খেলা থাকলে মানুষটা কেমন যেন হয়ে যান। দল হারলে শিশুদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।’’ তিনি জানান, এক বার মোহনবাগানের হারে মনের দুঃখে স্বামী তিন দিন বাড়ি ফেরেননি। ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারের পরে রেল লাইনে গিয়ে শুয়েছিলেন। লোকজনের চোখে পড়ে যাওয়ায় বিপদ এড়ানো গিয়েছিল।

বইয়ের পাতার মতো কলকাতা ময়দানের স্মৃতি ঘাঁটতে থাকেন মানুষটা। ১৯৬৭ সালে প্রথম ইডেন গার্ডেন্সে খেলা দেখতে যান। বসিরহাট স্টেশন থেকে ৩ টাকার টিকিটে কয়লার ইঞ্জিনে চেপে কলকাতায় যাওয়া। টিকিটের জন্য রাত জেগে লাইন দিয়েছিলেন। বৃষ্টিতে খেলা অবশ্য পণ্ড হয়ে যায়। বিএনআর থেকে ইস্টবেঙ্গলে আসার পরে মিহির বসু মোহনবাগানকে ২ গোল দিয়েছিলেন।

সেই খেলা দেখার পরে মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। জয়দেববাবু বলেন, ‘‘কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি শখের হাতঘড়িটা নেই।’’ ভূল করে ইস্টবেঙ্গল বা মহামেডান গ্যালারিতে বসে মোহনবাগানের গোলে হাততালি দিয়ে দর্শকের হাতে ধোলাইও খেয়েছেন। কিন্তু তাতে উৎসাহে ভাটা পড়েনি। মোহনবাগানে খেলা থাকলেই তিনি দলের জার্সি পরেন। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দলের পতাকা টাঙান। জিতলে বাজি ফাটান। মিষ্টি বিলোন। গগন মণ্ডল, গৌতম মণ্ডল, নিত্যানন্দ বিশ্বাস, আকাশ সেন, সত্যজিত বিশ্বাসরা বলেন, ‘‘মোহনবাগান জিতলেই মিষ্টি দাদুর কাছে ছুটে যাই মিষ্টি খেতে।’’ স্থানীয় মুকুল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই বয়সেও ছোটদের মতো উচ্ছ্বাস জয়দেববাবুর। এমন সমর্থকদের জন্যই কলকাতা ফুটবল বেঁচে আছে।’’

রবিবার অনেকের সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলেন জয়দেববাবু। সাঙ্গোপাঙ্গোরা জানাচ্ছেন, গোল খাওয়ার পর থেকেই মোহনবাগান দাদু স্বগতোক্তি করেছেন, মোহনবাগানকে ভারত সেরা হতে না দেখলে তিনি নাকি মরেও শান্তি পাবেন না। তবে শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়েননি! টিভির সামনে থেকেই কোচের কায়দায় হাত নাড়িয়ে নির্দেশ দিয়েছেন দলের ছেলেদের। শেষ পর্যন্ত তাঁর মুখে বিজয়ীর হাসি। আর তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাসের পালা। এ পাড়া থেকে মালা আসে তো ও পাড়া থেকে রসগোল্লা। রাতের মধ্যেই কুড়ি কেজি জিলিপি আর দশ কেজি দানাদার বিলিয়েছেন। বাজি ফাটাতে গিয়ে আঙুলও পুড়িয়েছেন। ভোর হতেই ছোটেন বাগদা চিংড়ির খোঁজে। সঙ্গে তিনশো লাড্ডু এবং দুশো দানাদার।

মোহনবাগানের কট্টর এই সমর্থকের কথায়, ‘‘মনে হয় জীবনের আয়ু অনেকটা বেড়ে গেল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE