Advertisement
১৭ মে ২০২৪

ঠাট্টা-ইয়ার্কির ডেভিসে নাদালের শত্রু শুধু গ্যালারি

চাণক্যপুরী। গ্রেটার কৈলাস। চিত্তরঞ্জন পার্ক। কনট প্লেস। সরোজিনী মার্কেট। বিকাজি কামা প্লেস। দিল্লির উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, গুটিকয়েক নিম্ন মধ্যবিত্ত— মোটামুটি প্রায় সব অঞ্চলে আজ বেলা বাড়তেই ‘জয় গণেশ জয় হো’ আর ‘আগলে সাল ফির আয়েগা’ চিৎকার! বিকেল গড়িয়ে সন্ধেতেও চলেছে।

ফুটবল স্কিলও ঝালিয়ে নিচ্ছেন নাদাল। দর্শক স্পেনের প্রাক্তন বিশ্বকাপার মরিয়েন্তেস। ছবি: উৎপল সরকার।

ফুটবল স্কিলও ঝালিয়ে নিচ্ছেন নাদাল। দর্শক স্পেনের প্রাক্তন বিশ্বকাপার মরিয়েন্তেস। ছবি: উৎপল সরকার।

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

চাণক্যপুরী। গ্রেটার কৈলাস। চিত্তরঞ্জন পার্ক। কনট প্লেস। সরোজিনী মার্কেট। বিকাজি কামা প্লেস। দিল্লির উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, গুটিকয়েক নিম্ন মধ্যবিত্ত— মোটামুটি প্রায় সব অঞ্চলে আজ বেলা বাড়তেই ‘জয় গণেশ জয় হো’ আর ‘আগলে সাল ফির আয়েগা’ চিৎকার! বিকেল গড়িয়ে সন্ধেতেও চলেছে। কলকাতার হাতিবাগান, বালিগঞ্জ, গড়িয়া, ভবানীপুরের রাস্তায় বিশ্বকর্মা পুজোর পরের ক’টা দিনের মতো ম্যাটাডর চেপে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে মিলে চলেছে ঠাকুর বিসর্জন দিতে। বড়-মেজো-সেজো-ছোট সাইজের গণেশ ঠাকুর। উত্তর ভারতের নিয়মে গণেশ চতুর্থীর দশম দিনে আজ ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার পালা।

একই শহরের মাটিতে ডেভিস কাপ থেকে ভারতের বিসর্জন তো ‘পুজো’ শুরুর আগে প্রতিপদে-ই হয়ে গেল যেন! এমনকী কেউ কেউ মনে মনে ‘আগলে সাল ফির আয়েগা’ বললেও হয়তো আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড গ্রুপ প্লে-অফ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আর তার পরে বিশ্ব টেনিসের কোনও হেভিওয়েট দেশের সামনে পড়ে ওয়ার্ল্ড গ্রুপ শেষমেশ অধরা থেকে যাওয়া তো প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ভারতের কাছে। আর তার মঞ্চ প্রায় ফি-বছর নয়াদিল্লি। ২০১৪ সার্বিয়া। ২০১৫ চেক প্রজাতন্ত্র। ২০১৬ স্পেন। তার ভেতর এ বারেরটা এমনই সুপার হেভিওয়েট, যাদের বিরুদ্ধে খেলা আর না-খেলা সমান। কারণ ম্যাচের সম্ভাব্য পরিণতি একটাই— ভারতীয় প্লেয়ারের হার। আন্তর্জাতিক টেনিস ফে়ডারেশনের (আইটিএফ) ভারতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট অনিল খন্না এ দিন ড্র-এর অনুষ্ঠানে কাচের পট থেকে যে মোড়া কাগজের টুকরোটা তুলে আগামী তিন দিনের সিঙ্গলস-ডাবলস-রিভার্স সিঙ্গলসের সূচি চূড়ান্ত করে দিলেন, তাতে নাম লেখা— রামকুমার রামনাথন। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, শুক্রবার প্রথম সিঙ্গলসে স্পেনের এক নম্বর রাফায়েল নাদালের মুখোমুখি হবেন রামকুমার। সরকারি ফটো সেশনে নাদাল-রামকুমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা পর্ব শেষ হতেই এই প্রতিবেদকের পাশের চেয়ারে বসা এআইটিএ-র এক কর্তা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘এই ছবিটা বাড়িতে সাজিয়ে রাখবে রামকুমার। কেউ রেজাল্ট জানতে চাইলে হয়তো বলবে, ওটা জিজ্ঞেস করিয়া আর লজ্জা দিবেন না!’’

জয়দীপ মুখোপাধ্যায় থেকে আখতার আলি, রোহিত রাজপালরা জনে জনে এখানে বলছেন, এত বড় ডেভিস কাপটাই ভারতকে কখনও নিজের দেশের কোর্টে খেলতে হয়নি। জয়দীপ বলছিলেন, ‘‘জিম কুরিয়ারের যুক্তরাষ্ট্র টিম যখন দিল্লিতেই খেলেছিল, সেই সময় কুরিয়ার বিশ্বের দু’নম্বর থাকলেও বাকিদের র‌্যাঙ্কিং খুব বেশি উপরের দিকে ছিল না। গোরান ইভানিসেভিচের ক্রোয়েশিয়া বা মার্সেলো রিয়সের চিলি দল সম্পর্কেও একই কথা বলব। ১৯৮৫ সালে বেঙ্গালুরুতে সুইডেনের টিমটা অবশ্য স্বপ্নের ছিল। স্টেফান এডবার্গ, আন্দ্রে ইয়ারিদ ও ম্যাটস উইল্যান্ডার। কিন্তু এডবার্গ সিঙ্গলসে খেলেনি। র‌্যাঙ্কিংয়েও দশের বাইরে ছিল তখন। তবে এই স্পেন দলে একে সর্বকালের অন্যতম গ্রেট টেনিস প্লেয়ার নাদাল আছে। বাকি তিন জনও বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম কুড়িতে থাকা প্লেয়ার। এত শক্তিশালী দল এ দেশে ডেভিস কাপে আগে আসেনি।’’

কে কার সামনে

• শুক্রবার

নাদাল (৪) বনাম রামকুমার (২০৩)

ফেরার (১৩) বনাম সাকেত (১৩৭)

• শনিবার

ফেলিসিয়ানো (১৩) ও মার্ক লোপেজ (১৯) বনাম লিয়েন্ডার (৬৩) ও সাকেত (১১৯)

• রবিবার

নাদাল (৪) বনাম সাকেত (১৩৭)

ফেরার (১৩) বনাম রামকুমার (২০৩)

কুরিয়ারের বিরুদ্ধে বছর বাইশ আগে এই ডিএলটিএ-র কোর্টেই প্রথম সিঙ্গলসে জিশান আলি হেরেছিলেন গোটা ম্যাচে মাত্র চারটে গেম নিতে পেরে। এ দিন টিম হোটেলে ড্র অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য লিফটে একসঙ্গে নামার সময় ভারতীয় দলের কোচ জিশানের কাছে জানতে চাইলাম, কাল নাদালের সামনে রামকুমার বা সাকেতের যে-ই পড়ুন, তাঁকে আপনার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এমন অসম যুদ্ধ করার কী টিপস দেবেন? আখতার আলির সর্বদা হাসিখুশি, নরম স্বভাবের ছেলের সাফ জবাব, ‘‘নাদালের বিরুদ্ধে খেলার আবার টিপস দেব কী? বলব, ওরে চেষ্টা করিস কুরিয়ারের থেকে আমি যে ক’টা গেম নিতে পেরেছিলাম, তার চেয়ে অন্তত দু-একটা বেশি নিতে!’’

ড্র-তে অবশ্য নাদালের সামনে প্রথম দিন রামকুমার। তাঁকে ওপেন মিডিয়া সেশনে দিল্লির এক মহিলা সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, কাল নাদালের বিরদ্ধে আপনার গেমপ্ল্যান কী? রামকুমার একপাশে আনন্দ অমৃতরাজ, অন্য দিকে লিয়েন্ডার পেজের মতো দু’জন সিনিয়রের মাঝে বসেও হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘‘সচিন তেন্ডুলকরকে কোনও ক্লাব বোলার বোলিং করতে গেলে তার কাছে কেউ কি জানতে চাইবে, কী ভাবে বল করবে? সে যতটুকু পারবে সেটাই করবে। আমিও কোর্টে নেমে নিজের মতো খেলব। গ্রেট নাদালের বিরুদ্ধে খেলতে পারাটাই আমার কাছে বিরাট সম্মানের। তবে যদি বলেন, নাদালকে ব্যাকহ্যান্ডে মেরে যাব পরের পর। ফোরহ্যান্ডের চেয়ে ওটা একটু হলেও তো কম শক্তিশালী নাদালের!’’ বছর একুশের তামিল তরুণের কথা শুনে গোটা হল হাসিতে ফেটে পড়ল।

দ্বিতীয় রাবারে স্পেনের দুই নম্বর সিঙ্গলস প্লেয়ার তথা বিশ্বের তেরো নম্বর তারকা দাভিদ ফেরারকে খেলবেন এই টাইয়ে ভারতের এক নম্বর সিঙ্গলস প্লেয়ার সাকেত মিনেনি। বিশাখাপত্তনমের বছর আঠাশের স্মার্ট ছেলে আবার লিয়েন্ডারের কথা অনুযায়ী ম্যাচ শুরুর আগেই জিতে বসে আছেন ডেভিস কাপের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে! কী, না গত রাতে দু’দলের অফিসিয়াল ডিনারে সাকেত তাঁর বহু দিনের বান্ধবী শ্রীলক্ষ্মীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি ‘হ্যাঁ’ বলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তটাকে সেলিব্রেট করতে এআইটিএ-র তরফে দু’জনের জন্য বিরাট কেক এনে কাটা হয় ডিনারের মধ্যেই। যেটা লিয়েন্ডারের ব্যাখ্যায়, ‘‘অলিম্পিক্স-টলিম্পিক্সে এ রকম হয়ে থাকে মাঝেমধ্যে। কিন্তু ডেভিস কাপে, বিশেষ করে ডেভিস কাপের অফিসিয়াল ডিনারের ইতিহাসে এটাই প্রথম প্রোপোজের ঘটনা!’’

প্রেমিকার মতো স্পেন টাইয়ের ব্যাপারেও দেখা গেল সাকেত সমান সিরিয়াস। লিয়েন্ডারের ১০৯তম ডাবলস পার্টনার হতে চলেছেন তিনি শনিবার। এ বারের ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন ফেলিসিয়ানো ও মার্ক লোপেজের বিরুদ্ধে নতুন জুটিকে হয়তো তাতাতেই দিল্লির ইংরেজি দৈনিকের টেনিসলিখিয়ে প্রশ্ন করলেন, স্পেন টাইয়ের আগে চারদিকে ভারতীয় প্লেয়ারদের নিয়ে এত হাসিঠাট্টা চলছে। এটা ভারতীয় দলকে আরও চাপে ফেলে দিয়েছে, নাকি আরও বেশি জেদি করে তুলছে? প্রায় লিয়েন্ডার-স্টাইলে সাকেতের থেকে জবাব ছুটে এল, ‘‘কোর্টের বাইরের কথাবার্তা নিয়ে আমাদের একফোঁটা মাথাব্যথা নেই। কোর্টের ভেতরের ব্যাপারটা কিন্তু একদম অন্য। ওখানে শুধুই বিজনেস। ওরা যেমন কাজে নামবে, আমরাও তো তাই!’’

ড্রয়ের আগে ম্যাচ রেফারি দু’দলের পরিচয়পর্ব সারার সময় নাদাল আর লিয়েন্ডারের শরীরীভাষা সম্পূর্ণ দু’রকম। লিয়েন্ডার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন সবার সঙ্গে মঞ্চে বসা আইটিএফ, এআইটিএ কর্তাদেরও। নাদাল সেখানে চেয়ারে বসেই দায়সারা হাত তুললেন। তাঁকে মিডিয়ার প্রশ্নে একবার বললেন, ‘‘একটু আস্তে আস্তে বলুন। অত ভাল ইংরেজি বুঝি না।’’ আর একবার বললেন, ‘‘এত লম্বা প্রশ্নের শুরুর দিকটা রিপিট করুন তো একবার।’’ শোনা গেল, প্রথম দু-একদিন না হলেও দিল্লির প্যাচপ্যাচে গরমে চার দিন কাটিয়ে নাদাল নাকি একটু ক্লান্ত আর সে জন্য খিটখিটে হয়ে উঠেছেন। হাজার হোক চ্যাম্পিয়নের ইগো তো!

যেমন দিনদুয়েক আগে সেরিনা-ভিনাস নিয়ে আচমকা ওঠা বিতর্কিত ইস্যুতে নিজের সেই পুরনো কথাটাই এ দিন আবার বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে, ‘‘ওয়াডার উপর ব্যক্তিগত ভাবে আমার একশো ভাগ বিশ্বাস আছে। বিশ্ব টেনিসে ডোপিং আটকাতে ওরা নিশ্চয়ই কোনও ফাঁক রাখছে না।’’

কোনও ফাঁক এআইটিএ-ও রাখতে চাইছে না। শহর দিল্লির বাইরে নয়ডায় গত পাঁচ দিন ‘ওয়ার্কিং ডে’-তেও রোজ স্টেডিয়াম ভর্তি করে দলীপ ট্রফি ফাইনাল দেখেছেন হাজার ছয়েক ক্রিকেটভক্ত। সৌজন্যে ‘ফ্রি এন্ট্রি’। সপ্তাহান্তের তিন দিন (তার মধ্যে দু’দিন ছুটি) দিল্লির টেনিসপ্রেমী আরও স্পষ্ট করে বললে নাদালভক্তদের জন্যও এক ব্যবস্থা— ডেভিস কাপ দেখতে কোনও টিকিট কাটতে হবে না। খন্না স্টেডিয়ামে সম্পূর্ণ ফ্রি এন্ট্রি। কিন্তু টেনিস কর্তারা তাতেও আশঙ্কায়। পাঁচ হাজারের গ্যালারি ভরবে কি না!

নইলে তো নাদালের অপমান! সে স্পেন ৫-০ যদি জেতে তাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nadal Davis cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE