Advertisement
১১ মে ২০২৪

একটা দরজা আর অনেকখানি রোদ

আমার কাছে শক্তি’র কবিতা ওই খোলা দরজা আর তার ওপারের দালানকোঠার মতো। ২৫ নভেম্বর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে কলম ধরলেন শ্রীজাতপ্রথম কেনা বইখানা ছিল ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’। কতই বা বয়েস হবে তখন আমার, ১৪ কি ১৫। পড়ার বইয়ের বাইরেও কবিতা পড়বার একটা নেশা চেপেছে সদ্য, টিফিনের পয়সা জমিয়ে একেক মাসে একেকখানা বই কিনছি কবিতার। লিখছেন শ্রীজাত।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

প্রথম কেনা বইখানা ছিল ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’। কতই বা বয়েস হবে তখন আমার, ১৪ কি ১৫। পড়ার বইয়ের বাইরেও কবিতা পড়বার একটা নেশা চেপেছে সদ্য, টিফিনের পয়সা জমিয়ে একেক মাসে একেকখানা বই কিনছি কবিতার। এই কবিকে, যার নাম মলাটের ওপর ছোট হরফে লেখা ছিল, পড়িনি তার আগে। নাম শুনেছি অনেক, গালগল্প শুনেছি, দাদা-দিদিদের মুখে মুখে ফেরা চমকে দেওয়া লাইনও শুনেছি বেশ কিছু, পড়িনি বই আকারে। তাই সে মাসের টিফিনের পয়সায় আমার ব্যাগে উঠে পড়লেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

সবজে মলাটে ছাই রঙের ছিমছাম গ্রামের মোটিফ, প্রচ্ছদটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। ছোট আর চৌকো এক বই, যাকে দেখামাত্র নিজের বলে মনে হতে থাকে। সেই রাতটা আমার আজও মনে আছে, থেকে যাবে সারা জীবন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে কত কত রাত যে হল্লায় আর নির্জনতায় কেটে গেছে, তার হিসেব নেই। কিন্তু প্রথম রাতের যে স্টিমার, সে আর পরে ফিরে আসে না।

এই সময়ে যা লেখা হচ্ছে, সবই দুর্বোধ্য— এমন অভিযোগ বড়দের মুখে শুনতে পেতাম মাঝে মধ্যেই। কিছু কবিতা পড়তে গিয়ে আমারও যে তা মনে হয়নি তখন, তা নয়। যদিও সে সব কবিতাও পরে কাছে এসেছে, কথা বলেছে। কিন্তু ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’ একেবারে অন্যরকম এক ভাষায় কথা বলে উঠল সেই রাতেই। আমার আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে এক সংলাপ শুরু করে দিল সেই বইখানাই।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছন্দের অলৌকিকতায় বুঁদ হয়ে থাকার একটা অভ্যেস দাঁড়িয়ে যায় পাঠকদের, কিন্তু তারও আগে যা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিল, তা হল তাঁর শব্দের বাছাই ও সেইসব শব্দের ব্যবহার। কী বলতে চাইছেন তা ভালমতো বোঝবার বয়েস না হলেও সেই রাতে এইটুকু বুঝেছিলাম, এই কবি আর পাঁচজনের চাইতে আপাদমস্তক আলাদা। তাঁর ভাবনায়, তাঁর ভাষায়, তাঁর উপস্থাপনায়। অমন আটপৌরে শব্দের বেড়া দিয়ে যে কবিতার মাঠ ঘিরে ফেলা যায়, সে ধারণা আমার সেইদিন হয়েছিল। ওইরকম সারল্যমাখা শব্দের চূড়ান্ত সফল ব্যবহার কেবল শুনেছিলাম রবি ঠাকুরের গানে। পরে শক্তিবাবু’র কবিতা বার বার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, হয়তো বা রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা আলাদা করে ওঁর কবিতাকে ভাবিয়েছিল।

আমি দেখছিলাম, হয়তো চেনা শব্দের উঠোন বলেই, কবিতারা বেশি দূরের মনে হচ্ছে না কিছুতেই। এই ছবি, এই গন্ধ, এই স্পর্শ, সবই আমার দেখার মধ্যে। অথচ সেইগুলোকেই জুড়ে জুড়ে কবি এমন এক আশ্চর্য পৃথিবী আর ভালবাসা তৈরি করছেন, যার কথা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কেবল এই জন্যেই তো একজন কবি বড় শিল্পী হয়ে থাকেন চিরকাল।

সেই যে শুরু হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ঘরবাড়িতে লুকোচুরি খেলে বেড়ানো, সে আজও শেষ হয়নি। এ এক আজব খেলা, যেখানে আমি নিজেই লুকোই বারবার, আর নিজেকেই খুঁজে বার করবার চেষ্টা করি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একেকখানা কবিতা থেকে ঘুরে এসে আমার চেহারা পাল্টে যায় একেকবার, ঠিক যেরকম সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে এলে গায়ে রোদের রং লেগে থাকে।

অথচ, তাঁকে আমি সামনা সামনি দেখিনি কখনও। যে মানুষটার কবিতার কোলেপিঠে বড় হয়েছি, যে কবির লেখা আমায় ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে, যার সঙ্গে আমার রোজকার বোঝাপড়া, প্রেম আর ঝগড়া, তাঁকে আমি একদিন, একবারের জন্যেও দেখিনি। কখনও ভেবেছি, চলে যাই একবার ওঁর আপিসে। কী আর হবে, বড়জোর দেখা করবেন না? তাই সই। কিন্তু সে সাহস জোগাড় করে উঠতে পারিনি কোনও দিন। কেবল একটার পর একটা বইয়ে ডুব দিয়ে খুঁজে পেয়েছি পুরনো জাহাজ আর তার ভেতর পড়ে থাকা, মরচে ধরে যাওয়া গুপ্তধন। আর গুপ্তধনের নেশা যে কী মারাত্মক, সে যে একবার পেয়েছে, সে-ই জানে।

নেশা। এক কথায় যদি বলতে চাই, ওঁর কবিতার অভিঘাতকে আমি এইভাবেই উল্লেখ করতে চাইব। কবিতার ভেতরে যে বিস্ফোরণ, যে উত্তাপ, যে আলোড়ন বা যে প্রেম আছে, তারা সব রয়েইছে নিজের জায়গায়। কিন্তু একের পর এক কবিতার পাঠ নিতে থাকলে একটা সময়ের পর নেশা অবধারিত। ওই ভাবনারাশির আফিম, ওই শব্দপুঞ্জের দ্রাক্ষা পাঠককে অবশ করবেই। এবং অবধারিত ভাবে, সে সময়ে অন্য কিছুই আর পড়া যাবে না, ভাবা যাবে না। তার চাইতেও বড় সমস্যা, ওঁর কবিতা পড়াকালীন নিজে কবিতা লিখতে যাওয়া। আমি একাধিকবার সেই হঠকারিতা করতে গিয়ে দেখেছি, প্রায় প্রতি লাইনে ওঁর ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওঁকে এড়িয়ে যাওয়া এতই কঠিন হয়ে পড়ে বারবার।

ওঁর কবিতার মধ্যে অনেক কিছু পেয়েছি আমি। কিন্তু সবচাইতে বেশি করে ঘুরে ফিরে পেয়েছি দুটো জিনিস। একটা হাট করে খোলা দরজা, আর রোদ। সবার কবিতায়, সব কবিতায় দরজা থাকে না। কবি রাখেন না অনেক সময়ে সহজে প্রবেশের কোনও উপায়। সে একরকম। কিন্তু ওঁর কবিতা ছিল একান্নবর্তী পরিবারের মতো। হাজার জন আসছে, উঠছে বসছে, অসংখ্য পাত পড়ছে দু’বেলা... সে এক মহাযজ্ঞ। আর এ সবের থেকে একটু দূরে, সদরের ফটক সারাদিন খোলা রয়েছে হাট করে। আমার কাছে শক্তি’র কবিতা ওই খোলা দরজা আর তার ওপারের দালানকোঠার মতো।

দেখুন গ্যালারি, হেমন্তের অরণ্যে এক পোস্টম্যান

আর পেয়েছি রোদ। আজও পাই। গনগনে তেজের একরোখা, জেদি রোদ। ওঁর কবিতাকে আমি রাতের বলে ভাবতে পারি না কখনও। রাতের ছবি কি নেই কোথাও? আছে। অজস্রবার আছে। কিন্তু এত এতদিন ধরে ওঁর কবিতা আমার কাছে একটা দিনের বেলা হয়েই থেকে গিয়েছে। হলদে সেই রোদে চোখ ঝলসে যায় বারবার, তবু তাকাতে হয়, এমনই তার পিছুটান।

এখন আমার মনে হয়, আমিও খুব কাছ থেকে দেখেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর চলন, তাঁর ভঙ্গি, তাঁর উদাসীনতা, তাঁর উচ্ছ্বাস, সবই আমার চেনা। মানুষ আর তার কবিতা যখন অভিন্ন হয়ে যায়, তখন তার কাছে পৌঁছে যেতে সময় লাগে না। তাই আমি তাঁর গলার স্বর শুনতে পাই চাইলে, ইচ্ছে হলে দেখতে পাই তাঁর একলা হেঁটে যাওয়া। কাছে যাই না। দূর থেকে অনুসরণ করি কেবল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE