Advertisement
০৮ মে ২০২৪

কখন কী হয়, তালা বন্ধ করে কাঁপল বামেরা

বড় দু’টো তালা ঝুলছে গ্রিলের লোহার গেটে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তবে গলার আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। ডাকাডাকি করতে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বললেন, ‘‘বলা যায় না কখন কী হয়। তাই তালা বন্ধ করে রেখেছি।’’

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

বড় দু’টো তালা ঝুলছে গ্রিলের লোহার গেটে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তবে গলার আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। ডাকাডাকি করতে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বললেন, ‘‘বলা যায় না কখন কী হয়। তাই তালা বন্ধ করে রেখেছি।’’

জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ভয়ে সন্ত্রস্ত বলরামপুর কিংবা আড়শা নয়। এটা বালি। এক সময় যেখানে সিপিএমের নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। আর ওই তালাবন্ধ বাড়িটা বালির সিপিএম জোনাল অফিস। বাম জমানায় গোটা বালি বিধানসভার ভোট নিয়ন্ত্রণ হতো সেখান থেকেই। আর এখন?

কর্মীটিকে অনুরোধ করে ঢোকা গেল ওই জোনাল অফিস— ‘পতিতপাবন পাঠক’ ভবনের ভেতরে। দেখা গেল, অফিস আগলে বসে রয়েছেন হাওড়া জেলা সিপিএমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শঙ্কর মৈত্র-সহ হাতে গোনা কয়েক নেতা-কর্মী।

দিকে দিকে বহিরাগতদের দাপটের অভিযোগ আসছে বহুক্ষণ ধরেই। অনেক বুথ থেকেই তারা বিরোধী এজেন্টদের বের করে দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অথচ বালির এক কালের তাব়ড় সিপিএম নেতাদের এক জনকেও দেখা গেল না, যিনি কর্মীদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। কেন এই করুণ অবস্থা? উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই পৌঁছনো গেল জোনাল অফিসে। আর সেখানে পৌঁছতেই পরিষ্কার, পৌর নিগমের ভোটে বালি থেকে কেন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গিয়েছে সিপিএম।

ভোট দিয়েছেন? প্রশ্ন করতেই জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শঙ্করবাবুর উত্তর, ‘‘চার বছর বাড়ি-ছাড়া! নেতৃত্বের পরামর্শে ভোট দিতে যাইনি। সকাল থেকে শাসক দল বুথ দখল করে মেরে আমাদের এজেন্ট ও প্রার্থীদের হটিয়েছে। কোন ভরসায় ভোট দিতে যাব?’’ পাশেই বসে থাকা দলের প্রবীণ নেতা রাজেন রায় যোগ করলেন, ‘‘সকালে ভোট দিয়ে এসেছি। আমাকে কেউ আটকায়নি।’’

কথাবার্তার ফাঁকেই সিপিআই প্রার্থী চন্দ্রশেখর ঝা বাড়ি যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন শঙ্করবাবু— ‘‘আপনাকে তো ওরা অপহরণ করবে বলেছে। খবরদার বেরোবেন না। ভোট মিটুক, পরিস্থিতি বুঝি। তার পর বাড়ি যাবেন।’’ বহিরাগতদের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষককে জানাননি? শঙ্করবাবুর উত্তর, ‘‘সকাল থেকে শুধু ১০০ টাকার এসএমএস-ই করলাম। কাজ হল না।’’ কিন্তু রাজ্যের অন্যত্র তো সিপিএম প্রতিরোধে গিয়েছে। সাতসকালের বিধাননগরেই তার প্রমাণ মিলেছে। সেখানে বালিতে অবাধ ভোট লুঠ দেখেও সিপিএম হাত গুটিয়ে বসে থাকল কেন? শঙ্করবাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘আমরা বালিতে কর্মীদের সঙ্ঘবদ্ধ করে নামাতে পারিনি।’’

একদা বালির অন্যতম ভোট নিয়ন্ত্রক, প্রাক্তন বিধায়ক কণিকা গঙ্গোপাধ্যায়কেও এ দিন দুপুরে বাড়িতে পাওয়া গেল। ভোটের দিন কণিকা ‘ঘরবন্দি’— এ ছবি গত কয়েক দশকে বালির মানুষ দেখেননি। অনেকেরই মনে আছে, ভোটের সময় সকাল থেকেই সাদা অ্যাম্বাসাডরে গোটা বালিতে চক্কর কাটতেন কণিকা। লাল পাড় সাদা শাড়ি আর কপালে বড় টিপ পরা নেত্রীকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলেই ভো‌টকেন্দ্র তটস্থ হয়ে উঠত। ‘দিদি’র সেই চেনা ছবিই এ বার অনুপস্থিত। সকালে বাড়ি থেকে বেরোননি? প্রশ্ন করতে অবশ্য পুরনো মেজাজেই কণিকাদেবীর জবাব, ‘‘ভোট দিয়েছি। আমাকে কে বাধা দেবে। আছড়ে ফেলব না! আমার মেয়েও তো এ বার এজেন্ট হয়েছে।’’

কণিকাদেবীর বাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ছিলেন বিশ্বজ্যোতি বসু। এক সময়ে বালিতে সিপিএমের ‘সেনাপতি’ বিশ্বজ্যোতিবাবু এখন পার্টি থেকে বহিষ্কৃত। প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের তোলা সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে বললেন, ‘‘কীসের সন্ত্রাস? বালিতে কি গুলি চলেছে, বোমা পড়েছে, না কেউ খুন হয়েছেন? আমি তো ১১ বছর পরে ভোট দিলাম, কেউ তো বাধা দিলেন না। আমার স্ত্রী ও ছেলে তো সিপিএমের এজেন্ট হয়েছে।’’

‘‘বালির সিপিএমের প্রতিবাদের স্বরটাই হারিয়ে গিয়েছে’’— আক্ষেপ বিশ্বজ্যোতিবাবুর। সেই অনুযোগ কানে নিয়েই টোকা মারা গেল সাবেক বালি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ীর বাদামতলার ফ্ল্যাটে। এ দিনের ভোটের হালহকিকত জানতে চাইলে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE