Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কিছু দেখেননি, পুলিশকে বললেন ভোটকর্মী

ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রিসাইডিং অফিসার। বীরভূমের থুপসড়া পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামে তাঁর ভোটের ডিউটি। রাজ্য পুলিশের লোক তাঁকে বুথে পৌঁছে দেন। ‘ভিলেজ পুলিশ’ ও জনাকয়েক স্থানীয় যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনিই। ‘এরা খুব হেল্পফুল’ জানিয়ে চলে যান তিনি। সাহায্য করলও বটে ওই ছেলেরা। স্কুলঘরে বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়ে দেওয়া, মাংস-ভাতের ব্যবস্থা, সবই করল। টাকা নিতে গেলে জিভ কাটল। এ তো অতিথিসেবা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রিসাইডিং অফিসার। বীরভূমের থুপসড়া পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামে তাঁর ভোটের ডিউটি। রাজ্য পুলিশের লোক তাঁকে বুথে পৌঁছে দেন। ‘ভিলেজ পুলিশ’ ও জনাকয়েক স্থানীয় যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনিই। ‘এরা খুব হেল্পফুল’ জানিয়ে চলে যান তিনি।

সাহায্য করলও বটে ওই ছেলেরা। স্কুলঘরে বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়ে দেওয়া, মাংস-ভাতের ব্যবস্থা, সবই করল। টাকা নিতে গেলে জিভ কাটল। এ তো অতিথিসেবা।

এই ‘অতিথিবৎসল’ যুবকদের এক জন পর দিন শাসকদলের এজেন্ট হয়ে বুথে বসলেন। বাকি যুবকরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে দিনভর গল্প করলেন। পেশায় শিক্ষক ওই প্রিসাইডিং অফিসারের কথায়, “ওই সকালেও ঘাম ছুটল আমার। আগের দিন আলাপ জমিয়ে নাম, কর্মস্থল, বাড়ির ঠিকানা সবই জেনে নিয়েছে ওরা। হঠাৎ ওদের এক জন এসে ভোটার তালিকার জনা দশেক ভোটারের নামে ‘টিক’ দিতে বলে ইভিএমের কাছে চলে গেল। বাধা দিতে গেলাম। যুবকটির জবাব, আগের রাতে তাঁরা আমাদের দেখেছেন। এখন তাঁদের না দেখলে চলবে কেন?” বাধা দিতে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে, এমন হুমকিও এল। এর পর আর বাধা দেননি ওই শিক্ষক। বিনা প্রতিবাদে বার দশেক তিনি ১০-১৫টি করে ভুয়ো ভোটারকে বিনা বাধায় ইভিএম মেশিনের বোতাম টিপতে দিয়েছেন।

ভোটের দায়িত্বে থাকা নানা বুথের প্রিসাইডিং অফিসার, ভোটকর্মী, পুলিশকর্মীদের বয়ান বুঝিয়ে দিচ্ছে, সূক্ষ্ম চাপ তৈরি করার নিপুণ নকশা প্রস্তুতই ছিল বীরভূম, বর্ধমান, হুগলির নানা এলাকায়। নীরব ত্রাসের বাতাবরণে আপাত-শান্তিতে ভুয়ো ভোট, বুথ দখল হতে পেরেছে।

এ সব কৌশলের কয়েকটি পরিচিত। যেমন, ভোটকক্ষের কাছে খোলা জানলার ও-পাশে মোতায়েন রাজনৈতিক কর্মীর নজরদারি। মঙ্গলকোটের একটি হাই মাদ্রাসার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বলছিলেন, “ওই হাই মাদ্রাসায় পরপর বেশ কয়েকটি বুথ। প্রতিটারই জানলা খোলা। জানলার পাশে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে। প্রিসাইডিং অফিসারকে বলতে গেলে তিনিই আমাকে উল্টে বলেন, ‘আপনি কিছু দেখেননি। আর আমিও কিছু দেখছি না।’ বেশ শান্তিতেই ভোট হয়ে গেল।”

লাভপুরের দাঁড়কা পঞ্চায়েতের এক প্রিসাইডিং অফিসারও একই রকম অভ্যর্থনা পান স্থানীয় যুবকদের কাছে। পরদিন যুবকদের ‘অনুরোধে’ তাদের বারবার যেতে দিতে হয়েছে ভোট মেশিনের কাছে। তারা সর্দি-কাশির মলম লাগিয়ে দিয়েছে বিপক্ষের সব ক’টি বোতামে। আঙুলের ‘গন্ধবিচার’ করে বুথ-ফেরত ভোটারদের হয়রানি করা হয়েছে কি না, জানেন না ওই অফিসার। কিন্তু ভোটার, ভোটকর্মীদের উপর চাপ তৈরির এই কৌশল রোখা যায়নি, তা মানছেন।

এ ভাবে গোপন নজরদারির প্রচার করে চাপ তৈরি বহু পুরনো কৌশল। প্রযুক্তির সুযোগে তা আরও বাড়ছে। সাঁইথিয়ার আমোদপুর লাগোয়া একটি গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, একটি দলের কর্মীরা তাঁদের মোবাইল ফোন ধরিয়ে বলেছেন, ফোনের ভিডিও ক্যামেরায় দলের চিহ্নের বোতাম টেপার ছবি ও শব্দ তুলে আনতে হবে। বাইরে এসে সেই ছবি দেখাতে হবে।

মারধরের সাবেকি প্রথাও কিন্তু লুপ্ত হয়ে যায়নি। কেতুগ্রামের রাজুর পঞ্চায়েতের একটি বুথের ভোটকর্মী বলেন, “মক পোলের ভিডিও ছবি নেওয়ার পরেই বিরোধী এজেন্টদের মারধর করে তাড়িয়ে দিল শাসকদল। তার পর ভোটকক্ষের সামনে পালা করে এক জন দাঁড়িয়ে রইল।” হুগলির ধনেখালিতে কানানদী এলাকায় বিজেপির এক এজেন্ট গিয়েছিলেন ডিউটি দিতে। সে দিনের পর থেকে তিনি ঘরছাড়া। মোবাইল এখনও বন্ধ। জেলার বিজেপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেও অস্বীকার করেছেন তাঁর মা। পুলিশে অভিযোগ তো দূরের কথা।

‘অসুস্থ’ লোকের ‘সঙ্গী’ হয়ে ভোটের বোতাম টেপাও চেনা কৌশল। নানুর ও লাভপুর থানার সীমান্তে কেতুগ্রামের একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, “আমার বুথে আনুমানিক ৭০০ ভোটার। সকাল ১০টার মধ্যে ১৮৬টি ‘অ্যাকোম্পানি’ ভোট পড়ে গিয়েছিল।” জনসংখ্যার ৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী ধরা হয়। ভোটের দিন একটি এলাকায় কী করে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী হয়ে গেলেন, আর তাঁরা কী করেই বা প্রায় দল বেঁধে ভোট দিতে এলেন, তা প্রশ্ন করার সাহস পাননি ওই প্রিসাইডিং অফিসার।

সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কালো টিশার্ট পরা এক যুবক নানা মানুষকে নিয়ে ভোট কক্ষে যাচ্ছেন। ভোটদাতা ঝুঁকে পড়ে সব ক’টা বোতাম বুঝে ওঠার আগেই ওই যুবক কার্ডবোর্ডের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে বোতাম টিপে দিচ্ছেন। ভোটদাতা চুপচাপ চলে আসছেন। চেয়েও দেখছেন না ভোটকর্মীরা, তাঁরা আঙুলে কালি লাগাতে, তালিকায় টিক দিতে ব্যস্ত।

এমন নানা অভিযোগের মধ্যেও উদ্বেগজনক, পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় দলীয় কর্মীদের যোগসাজশের সম্ভাবনা। কমিশনে রাজ্যের মুখপাত্র অমিত চৌধুরী বলেন, “দিল্লি থেকে যে সব অভিযোগ সম্পর্কে রিপোর্ট চাওয়া হয়, তার মধ্যে রিগিং, ছাপ্পার অভিযোগও আছে। রিপোর্ট সোমবারই পাঠিয়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন।” সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করা ভিডিও বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রার্থীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নজর রাখছি। তার বেশি সম্ভব হচ্ছে না।”

পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্যের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) এম কে সিংহ বলেন, “এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। যা বলার নির্বাচন কমিশন বলবে।”

এই ধরনের অভিযোগ অধিকাংশই শাসকদলের বিরুদ্ধে তুলছে বিরোধীরা। তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যাদের জনভিত্তি নেই, তারাই এই ধরনের অভিযোগ করছে। ভোট ভালই হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election commission poling agent preciding officer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE