ঝাড়গ্রাম আদালতে ধৃত তৃণমূল নেতা জয়রাম টু়ডু। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন ‘জঙ্গলমহল হাসছে’। সেই জঙ্গলমহল থেকে তাঁরই দলের এক নেতাকে বৃহস্পতিবার তাঁর পুলিশ গ্রেফতার করল মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে! সেই নেতার বিরুদ্ধে রুজু করা হল ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন)-র ধারাও। রাজ্যে পালাবদলের পরে এমন ঘটনা এই প্রথম।
ধৃত জয়রাম টুডু তৃণমূলের বেলপাহাড়ির ভেলাইডিহার অঞ্চল সভাপতি। এত দিন তিনি প্রকাশ্যে দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন, দিব্যি ঘোরাফেরা করেছেন এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশের খাতায় ছিলেন ‘ফেরার’। কিন্তু বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হাতিডোবা গ্রামের বাসিন্দা, বছর ৩২-এর জয়রামকে গ্রেফতারের আগে তাঁর বাড়ি থেকে পুলিশ দু’টি ল্যান্ডমাইন, একটি কার্বাইন, ১৫ রাউন্ড নাইন এমএম কার্তুজ এবং মাওবাদী পোস্টার-ব্যানার উদ্ধার করে। ইউএপিএ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ, বেআইনি অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা এ দিন জানিয়েছেন, খুন-নাশকতা-অপহরণের পুরনো তিনটি মামলায় আগেই ধৃতের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত ওই ব্যক্তি এত দিন ফেরার ছিলেন। ধৃতকে শুক্রবার ঝাড়গ্রাম এসিজেএম (প্রথম) আদালতে হাজির করানো হয়। তাঁকে সাত দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক।
দলের নেতা এ ভাবে গ্রেফতার হওয়ায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে শাসকদল। বিশেষ করে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ঘটনা বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবে বলে আশঙ্কা করছে তৃণমূল নেতাদের একাংশ। বিরোধীরাও প্রশ্ন তুলছেন, দু’দিন আগেই রেড রোডের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘টাচ উড, জঙ্গলমহল হাসছে।’’ তা হলে আবার কী করে বেলপাহাড়িতে শাসকদলের নেতাই ধরা পড়েন? এ তো সর্ষের মধ্যেই ভূত!
বাম আমলে রাজ্যে মাওবাদী নাশকতা যখন তুঙ্গে, তখন সিপিএম নেতাদের মুখে প্রায়ই শোনা যেত, ‘দিনে যারা তৃণমূল, রাতে তারাই মাওবাদী’। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একাধিক বার বলেছেন— জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসাজশের অনেক অভিযোগ এবং তথ্য তাঁদের হাতে ছিল। এখন তৃণমূলের জমানাতেই শাসকদলের নেতার এই গ্রেফতারি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
জয়রাম টুডু আগে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) করতেন। ২০০৮ সালে ওই দলের পক্ষ থেকে তিনি ভেলাইডিহা পঞ্চায়েতের সদস্য হন। পরে জঙ্গলমহলের অশান্তি-পর্বে তিনি মাওবাদী-জনগণের কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায় ঝাড়খণ্ড পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করে। খুন-অপহরণ-নাশকতার বেশ কিছু মামলাতেও অভিযুক্ত হন তিনি। বেলপাহাড়ির বিরিডাঙা গ্রামের সিপিএম কর্মী সুখময় হেমব্রম অপহৃত হন ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০। পরে বিনপুরে তাঁর কঙ্কাল মেলে। অপহরণ করে খুন ও প্রমাণ লোপাটে অন্যতম অভিযুক্ত এই জয়রাম টুডু। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর বেলপাহাড়ির ওড়গোন্দায় পুলিশের চর সন্দেহে গরু ব্যবসায়ী রঞ্জিত দাসকে অপহরণ করে মাওবাদীরা। আজ পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি। দেহও মেলেনি। সেই মামলাতেও অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত এই তৃণমূল নেতা। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি তারাফেনি সেতুর কাছে ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণের মামলাতেও তিনি অভিযুক্ত। এই তিন মামলাতেই তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত।
রাজ্যে পালাবদলের পরে জয়রাম তৃণমূলে যোগ দেন। ভেলাইডিহা অঞ্চল সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। দলীয় নেতারাই
বলছেন, এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। পঞ্চায়েত প্রধানকে টপকে তাঁর কাজকর্ম জয়রামই পরিচালনা করতেন।
এত দিন পরে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁকে গ্রেফতার করা হল কেন— তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, এলাকায় নতুন করে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে মাওবাদীরা। পুরনো লোকজনের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছে। টাকা লেনদেনও হচ্ছে। কিছু দিন আগে মাওবাদীরা রাতে জয়রামের বাড়িতে বৈঠক করেছিল বলে খবর পায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার পুলিশের কাছে গোপন সূত্রে খবর আসে, জয়রামের বাড়িতেই মাওবাদীদের অস্ত্র ও মাইন মজুত রয়েছে। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছে, কত জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা এখনও কার্যকর হয়নি। এক দিকে অস্ত্রশস্ত্র রাখার গোপন খবর, অন্য দিকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ— সব মিলিয়ে পুলিশকর্তারা আর হাত গুটিয়ে থাকার ঝুঁকি নেননি।
তবে পুলিশের এই তত্পরতায় শাসক দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। বেলপাহাড়ির নেতৃত্ব সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। তৃণমূলের বেলপাহাড়ি ব্লক সভাপতি
বংশীবদন মাহাতো ‘খোঁজ নিচ্ছি’ বলে ফোন কেটে দেন। দলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলা সভাপতি চূড়ামণি মাহাতো বলেন, “কী কারণে জয়রামকে ধরা হল জানি না!” বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “পঞ্চায়েতের লুঠের টাকা মাওবাদীদের তহবিলে যাচ্ছে কি-না, সেটাও দেখুক পুলিশ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy