Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চালানি বা খয়রায় সংস্কার রক্ষা কাঠ বাঙালদের

গড়িয়াহাট বাজারে ‘জলের রুপোলি শস্যের’ খোঁজে সাতসকালে অভিযান। শনিবার, সরস্বতী পুজোর ইলিশ খুঁজছেন খাস ফরিদপুরি, বালিগঞ্জবাসী শান্তনু বসু। বেছেবুছে যে ‘ইলিশ’ থলেয় ভরলেন, তার সাকিন পদ্মা বা গঙ্গার ত্রিসীমানায় নয়!

সরস্বতী পুজোর সকালে শহরের বাজারে চালানি ইলিশ।—নিজস্ব চিত্র।

সরস্বতী পুজোর সকালে শহরের বাজারে চালানি ইলিশ।—নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৮
Share: Save:

গড়িয়াহাট বাজারে ‘জলের রুপোলি শস্যের’ খোঁজে সাতসকালে অভিযান। শনিবার, সরস্বতী পুজোর ইলিশ খুঁজছেন খাস ফরিদপুরি, বালিগঞ্জবাসী শান্তনু বসু। বেছেবুছে যে ‘ইলিশ’ থলেয় ভরলেন, তার সাকিন পদ্মা বা গঙ্গার ত্রিসীমানায় নয়!

মাছের দাম ২০০ টাকা কেজি। দাম মিটিয়ে প্রবীণ গৃহস্থের হাসি, ‘‘এ হল মিছিমিছি ইলিশ। ভিয়েতনামের মাছ। মেকং-টেকংয়ের হবে। কাঁটা বেশি। কিন্তু টেস্ট মন্দ নয়!’’ একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘অন্তত বেটাইমের পানসে ইলিশের থেকে খারাপ খেতে, বলা যাবে না।’’ মাছ আমদানিকারী সমিতির সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদ পরে বললেন, ‘‘ভিয়েতনাম নয়। এ হল দুবাইয়ের অতিথি। আদতে একটু বড়-সড় খয়রা। চেহারা-চরিত্রে ইনিই ইলিশের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছেন!’’ গড়িয়াহাট বাজারের দিলীপ মণ্ডলও বললেন, ‘‘পড়তায় পোষায় না-বলে অনেকে জোড়া

পুঁটি দিয়েও সরস্বতী পুজোর পরম্পরা রক্ষে করেন।’’

‘ঘটির দেশে’ দুর্বিপাকের অন্ত নেই। এ পারের অর্বাচীন খোকা ইলিশে কদাচ মন ভরে। তার উপরে কয়েক বছর হল, পদ্মার ইলিশ রফতানি বন্ধ। তাতে ‘দ্যাশের স্বাদ’ আরও দুর্লভ। সরস্বতী পুজোর দিনটা একটু ইলিশ দাঁতে না-কাটলে তবু বহু কাঠ বাঙালেরই মনটা খাঁ-খাঁ করে। পঙ্কজ রায়দের পরিবার, ভাগ্যকুলের রায়বাড়ির ছেলে বেণীমাধব রায়ের কথায়, ‘‘সরস্বতী পুজোতেই আমাদের বাড়ির গোটা বছরের ইলিশ ভোজের সূচনা। চলবে বিজয়া দশমী অবধি। এর পরে আর ইলিশ খাওয়া চলবে না।’’

প্রবীণ সমুদ্রবিজ্ঞান বিশারদ অমলেশ চৌধুরী এই ইলিশ-রীতির মধ্যে সে-যুগের বাঙালি জীবনে শৃঙ্খলার ছাপ দেখছেন। এমনিতে সরস্বতী পুজোর আচারের সঙ্গে কিন্তু ইলিশের সম্পর্ক নেই। স্রেফ পুজোর শুভযোগে ইলিশ-বিলাসটুকু চালু করা হয়। জোড়া ইলিশ যে সকলেই খাবেন, তা-ও নয়। কিন্তু বিজয়া দশমীর পরে কয়েক মাসের ইলিশ-উপবাস শিরোধার্য। এর পরে মিষ্টি জলে সদ্যোজাত নবজাতকদের নির্বিঘ্নে সমুদ্রে ফিরে যেতে দিতে হবে। সাগরের নুন মেখে কিঞ্চিৎ ডাঁটো হওয়ার পরেই তারা ফের বংশরক্ষায় নদীতে ফিরবে। স্বাদু জলচরেদের তত দিন বেড়ে ওঠার সময়টুকু দিতে হবে।

অমলেশবাবুর মতে, ‘‘মোটামুটি সরস্বতী পুজোর মধ্যে এক ঝাঁক ইলিশের নদী থেকে সাগরযাত্রা চুকে যায়। আবার অন্য এক ঝাঁকের মিষ্টি-জল অভিযানেরও এখনই সূচনা।’’

তাঁর কথায়, ‘‘বর্ষায় ইলিশের ভরা মরসুম আসতে দেরি থাকলেও, সরস্বতী পুজো থেকেই ইলিশ ভোগে কোনও রকম দোষ নেই।’’ বিক্রমপুরের সুসন্তান লেখক বুদ্ধদেব বসু অবধি শ্রী পঞ্চমীর তরুণ ইলিশের নিরাভরণ ঝোলের প্রশস্তি গেয়ে গিয়েছেন।

এ যুগে বাঙালির ইলিশ অবশ্য আদতে ‘ঠান্ডা ঘর’ বা কোল্ডস্টোরেজ-এর বাসিন্দা। এর বড় অংশ মায়ানমার থেকে আসে। এ ছাড়া, রোজকার ইলিশ-জোগানে মু্ম্বই-গুজরাতের মাছই দলে ভারী। চোরাগোপ্তা পদ্মার ইলিশও কিছু ঢুকছে। মৎস্য দফতরের কর্তাদের আফশোস, ‘‘নির্বিচারে কম ওজনের ছোট ইলিশ শিকারের ফলেও ইলিশবংশ এই বাংলায় নির্মূল হতে চলেছে।’’ মৎস্য দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা মধুমিতা মুখোপাধ্যায় মানছেন, ‘‘বাংলাদেশ কড়া হাতে ছোট ইলিশ শিকার বন্ধ করতে পারলেও এই বাংলায় তা এখনও তত সাফল্য পায়নি।’’

এই ছোট ইলিশ ও হিমঘরের ইলিশের রমরমার পটভূমিতেই টিকে আছে সরস্বতী পুজো। বাজার থেকে ইলিশ কেনা হলেও তা আদৌ সদ্য মিষ্টি-জলমুখী বছরের প্রথম ইলিশ কি না সন্দেহ! সে-কালের বিস্মৃত পার্বণের কথা ভেবেও অনেক প্রবীণ বাঙালের তবু দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রীতিমাফিক, বাড়ির বড় ছেলে শুদ্ধ বস্ত্রে স্নান সেরে তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ঢুকবেন। ঢোকবার আগে দাওয়ায় রেখে তেল-সিঁদুর লেপে প্রথমে পুজো হবে মৎস্যকুল শিরোমণির। মাছের রাজা তবে হেঁসেলে ঢুকবেন।

ঢাকার কাছের মেঘলা গাঁয়ের ভূমিপুত্র বাঘাযতীনবাসী বেদব্রত ভট্টাচার্যের কাছে ইলিশ আবার রাজা নন। ‘মাছের রানি’। বছরের প্রথম ইলিশ হল নতুন বউ। রান্নাঘরে নোড়ার সঙ্গে বিয়ে হবে তার। উত্তর কলকাতার কোনও কোনও বনেদি ঘটি-বাড়িতেও এই অভিনব বিয়ের পরম্পরা জারি রয়েছে। তবে সেটা ভরা বর্ষায়। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। সাবেক ঘটি-বাড়িও কিন্তু পুজোর পরে ইলিশটা এড়িয়েই চলত।

সরস্বতী পুজোর জোড়া ইলিশের নেপথ্যে কিন্তু স্রেফ এই ঔচিত্যবোধটুকুই নেই। কারও কারও ধারণা, এর পিছনে বাঙালদের প্রবাদপ্রতিম ‘হাকচ’ বা হ্যাংলামির প্রেরণা। শিলনোড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে যে ইলিশটি ঘরে তোলা হল, তা শুধু টলটলে কাঁচা ঝোল-অবতার হয়েই পাতে আসবে। কিন্তু মোটে এক পদ ইলিশে কী আর স্বাস্থ্যরক্ষা সম্ভব। কেউ কেউ বলেন, আর একটি ইলিশ মনের মতো করে গরগরে উগ্রতেজ রান্নায় রসনাপূর্তির বন্দোবস্ত করা হতো। পর্যাপ্ত গুষ্টিসুখের স্বার্থে কোনও কোনও বাড়িতে তিন জোড়া থেকে চার জোড়া ইলিশ আমদানির কাহিনিও শোনা যায়!

এখানে অবশ্য একটু সতর্কতা দরকার। গানের দল ‘মহীনের ঘোড়া’দের এক জন, বেঙ্গালুরুনিবাসী বরিশাইল্যা রঞ্জন ঘোষাল বাঙালদের ‘বাড়িয়ে বলা’র অভ্যেসটির বিষয়ে সাবধান করছেন। তাঁর দাবি— জোড়া ইলিশ কেনা কোনও যুগেই গেরস্তের জন্য নেহাত জলভাত ছিল না। বরিশালেই ইলিশ আসত নৌকায় উজিয়ে দক্ষিণ পটুয়াখালি থেকে। তার খরচও নেহাত কম ছিল না। সাবেক পুব বাংলায় ইলিশের জন্য প্রসিদ্ধ অনেক এলাকাই।

তবে ঢাকার কাছের কিছু এলাকা— প্রধানত বিক্রমপুর, ফরিদপুর, ভাগ্যকুলের উত্তরপুরুষরাই সরস্বতী পুজোর জোড়া ইলিশ-আবেগ নিয়ে একমত হন।

ইলিশের দামে ছ্যাঁকা লাগার অভিজ্ঞতাটুকু বলা বাহুল্য এ পার বাংলাতেও জারি রয়েছে। গড়িয়াহাটে দেড় কিলোর ইলিশের এ দিন দর উঠল, ১৮০০ টাকা কিলো। লেক মার্কেটেও একই দাম। মানিকতলা বাজারে সামান্য কম। এক কিলো ইলিশের দর, ১২০০-১৪০০ টাকা। শিলিগুড়ির রেগুলেটেড মার্কেটেও এক কিলোর দাম ১২০০ টাকা।

৪০০ থেকে ৬০০-৭০০ গ্রামের ছোট ইলিশ অবশ্য সর্বত্র ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে বিকিয়েছে, এবং তারাই দলে ভারী।

তবু এখনও, যে যেখান থেকে পারছেন আমদানি করে ইলিশ পৌঁছে দিচ্ছেন বাঙালির পাতে। ভজহরি মান্না রেস্তোরাঁ চেনের কর্তা রাজীব নিয়োগী বলছেন, ‘‘ইলিশের পদের কাটতি সরস্বতী পুজোয় শতকরা ৩০-৪০ ভাগ বেড়ে গিয়েছে।’’

হিমঘরের মাছের কুলগোত্র কে জানে! তবু অতীতের সঙ্গে সংযোগরক্ষাটুকুই এখনও সম্বল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE