Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ছেলের চিন্তায় খাওয়া ভুলেছেন সারদা-কর্তা

মানুষটা যেন বেবাক বদলে গিয়েছেন। হাজারো ঝড়-ঝাপটা, বিপর্যয়ের মুখেও যে মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়নি, দিন দশেক ধরে সেই মুখই ঢাকা পড়েছে দুশ্চিন্তা আর বিষণ্ণতার মেঘে। সারাক্ষণ গুম মেরে রয়েছেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় করছেনই না। আইনজীবীর সঙ্গে দেখা হলেই শুধোচ্ছেন ছেলের কথা “রাজা কেমন আছে? ওকে কেমন দেখলে?”

অত্রি মিত্র ও শিবাজী দে সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

মানুষটা যেন বেবাক বদলে গিয়েছেন।

হাজারো ঝড়-ঝাপটা, বিপর্যয়ের মুখেও যে মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়নি, দিন দশেক ধরে সেই মুখই ঢাকা পড়েছে দুশ্চিন্তা আর বিষণ্ণতার মেঘে। সারাক্ষণ গুম মেরে রয়েছেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় করছেনই না। আইনজীবীর সঙ্গে দেখা হলেই শুধোচ্ছেন ছেলের কথা “রাজা কেমন আছে? ওকে কেমন দেখলে?”

যে পুত্রের চিন্তায় কারাবন্দি পিতার মন আকুল, তাঁর আবাসও এখন কারাগার। এবং তিনিও ভাল নেই। সেল থেকে বিশেষ বেরোচ্ছেন না। থেকে থেকে শুধু আক্ষেপ করছেন, “আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।”

বাবা হলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। মাস কয়েক হল যিনি বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। আর তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে, অর্থাৎ সদ্য গ্রেফতার হওয়া শুভজিৎ সেন ওরফে রাজা আপাতত প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেলের কয়েদি। সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) দিন দশেক আগে শুভজিৎ ও সুদীপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালিকে গ্রেফতার করেছিল। শুক্রবার কোর্টের নির্দেশে শুভজিৎকে ইডি-হেফাজত থেকে জেল হেফাজতে পাঠানো হয়। আদালতের কাছে শুভজিতের কৌঁসুলির আর্জি ছিল, তাঁর মক্কেলকে বাবার সঙ্গে একই জেলে রাখা হোক। বিচারক আর্জি মানেননি।

তাই গত তিন দিন যাবৎ রাজার নতুন ঠিকানা প্রেসিডেন্সি জেল। নতুন আসা কয়েদিদের প্রথমে সাধারণত ‘আমদানি ওয়ার্ডে’ রাখাটাই রেওয়াজ। পরে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে। তবে শুভজিতের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। কী রকম?

প্রেসিডেন্সি জেল-সূত্রের খবর: শুক্রবার সন্ধ্যায় ওঁকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘সেল’ ব্লকে। ব্লকটির দু’টো ভাগ। কারা-পরিভাষায় একটির নাম পয়লা-২২ ওয়ার্ড। অন্যটা ২৩-৪৪ ওয়ার্ড। কড়া নিরাপত্তায় শুভজিৎকে পয়লা-২২ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। ছ’ফুট বাই ছ’ফুটের সম্পূর্ণ আলাদা একটা সেলে। প্রসঙ্গত, পয়লা বাইশের অন্যান্য সেলের বাসিন্দাদের মধ্যে অন্যতম খাদিম-মামলার অন্যতম অভিযুক্ত তথা আফতাব আনসারির সঙ্গী জামিরুদ্দিন নাসির, কুখ্যাত দুষ্কৃতী শেখ বিনোদ, মাওবাদী মধুসূদন মণ্ডল-পতিতপাবন হালদারেরা। সেখানে শুভজিতের কাটছে কেমন?

প্রেসিডেন্সি জেলের খবর, খুবই মুষড়ে আছেন সারদা-কর্তার পুত্র। এমনিতে সকালে আটটা থেকে বারোটা, আর বিকেলে চারটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কয়েদিদের সেলের বাইরে বেরোতে দেওয়া হয়। শুভজিৎ কার্যত বেরোচ্ছেনই না। অন্য কয়েদিদের সঙ্গে কথাবার্তাও বিশেষ বলছেন না। প্রায় সারাক্ষণ সেলের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে-বসে থাকছেন। “আমাদের সঙ্গে অবশ্য মাঝে মাঝে কথা বলছেন। থেকে থেকে ডুকরে উঠছেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ছেন।” জানান এক জেলকর্মী। তিনি এ-ও বলেন, “শুভজিৎ এসেছিলেন জিন্স আর কালো টি-শার্ট পরে। সঙ্গে একটা হাল্কা নীল চেক লুঙ্গি নিয়ে এসেছিলেন। ওঁর সঙ্গে আর কিছু ছিল না।”

সেলে ঢোকা ইস্তক রাজার পরিধানে সেই লুঙ্গি। অধিকাংশ সময়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ খালি, কখনও-কখনও কালো টি-শার্টটি গলিয়ে নিচ্ছেন। দাঁতের মাজন, সাবান ইত্যাদি জেল থেকে দেওয়া হয়েছে। অন্য বন্দিদের কাছে গামছা ধার করে স্নান সেরেছেন। যদিও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন খুব। “এত আরামে থাকতেন! এসি বাড়ি, এসি গাড়ি! ঘুপচি সেলে চল্লিশ ডিগ্রির গরমে কষ্ট তো হবেই!” মন্তব্য এক কারাকর্মীর। সেলে অবশ্য ফ্যান রয়েছে। মাটির কুঁজোয় জল।

বিলাস-ব্যসনের চুড়ো থেকে একেবারে কঠোর বাস্তবের জেল-জমিতে। তাঁর এই দুর্দশার কথা শুনলে বাবা যে কষ্ট পাবেন, ছেলে তা বিলক্ষণ জানেন। ছেলের জন্য বাবা যেমন উদ্বিগ্ন, বাবার কারণে ছেলেরও চিন্তার শেষ নেই। আইনজীবীর কাছে তাই বারবার বাবার খবর নিয়েছেন রাজা। শুধিয়েছেন, “আমাদের এই অবস্থা শুনে বাবা কেমন আছেন?” আইনজীবীকে তাঁর অনুরোধ, “আপনারা দেখবেন, বাবা যেন ভেঙে না-পড়েন।”

কিন্তু বাবা ইতিমধ্যে ভেঙেই পড়েছেন। ক’দিন আগেও যে মানুষটা দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করছিলেন, জেরা-মামলার নিরন্তর চাপেও মেজাজ হারাননি, স্ত্রী-পুত্রের গ্রেফতারির সংবাদ আসা ইস্তক তাঁর ভাব-গতিক সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। আলিপুর জেল-সূত্রের খবর, সপ্তাহখানেক ধরে সারদা-কর্তা খাওয়া-দাওয়া করছেন নামমাত্র। চোখে-মুখে সর্বক্ষণ উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার ছাপ। সে ভাবে বাক্যালাপও করছেন না। এক জেল-কর্মীর কথায়, “খাওয়া-দাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকছেন। কখনও বলছেন, মন্ডা-মিঠাই যাই-ই দেন, এখন আমাকে ডাল-ভাত খেয়ে থাকা অভ্যেস করতে হবে। অল্প ডাল-ভাত খেয়েই তো ভাল আছি!”

‘সেনবাবু’ আদতে কেমন আছেন, আইনজীবীদের কাছে বার বার তা জানতে চাইছেন তাঁঁর স্ত্রী পিয়ালিও। গত শুক্রবার জামিন হয়ে গেলেও জামিনদার না-মেলায় তাঁকে আলিপুর মহিলা জেলে পাঠানো হয়েছে। বাড়িতে দুই সন্তানের কথা ভেবেও ছটফট করছেন সারদা-কর্ণধারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। পিয়ালির আইনজীবী সমীর দাস রবিবার বলেন, “জামিনদার খোঁজা হচ্ছে। আশা করি, সোমবার জোগাড় হয়ে যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

atri mitra sibaji de sarkar sarada sudipta sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE