Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কমছে পডুয়াদের উপস্থিতি

ঝুঁকি নিয়েই স্কুলের পথে পড়ুয়ারা

ঘোর বর্ষায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু এলাকার অভিভাবকেরা। কোথাও পাশের পুকুর উপচে জল ঢুকে পড়েছে স্কুল প্রাঙ্গণে। কোথাও স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় জল জমেছে। কোথাও আবার বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়েছে স্কুলে। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের প্রশ্ন, ‘‘স্কুল কিংবা স্কুলের পথ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে কোন ভরসায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাব?’’ শিক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই উদ্বেগ কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়।

জল জমায় বন্ধ রয়েছে স্কুল। তাই স্কুল চত্বরেই মাছ ধরতে ব্যস্ত এক পড়ুয়া। ডান দিকে, জল ঘেঁটে স্কুল যাচ্ছে পড়ুয়ারা। সাটুই ও করিমপুরে গৌতম প্রামাণিক ও কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।

জল জমায় বন্ধ রয়েছে স্কুল। তাই স্কুল চত্বরেই মাছ ধরতে ব্যস্ত এক পড়ুয়া। ডান দিকে, জল ঘেঁটে স্কুল যাচ্ছে পড়ুয়ারা। সাটুই ও করিমপুরে গৌতম প্রামাণিক ও কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০০:২০
Share: Save:

ঘোর বর্ষায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু এলাকার অভিভাবকেরা।
কোথাও পাশের পুকুর উপচে জল ঢুকে পড়েছে স্কুল প্রাঙ্গণে। কোথাও স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় জল জমেছে। কোথাও আবার বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়েছে স্কুলে। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের প্রশ্ন, ‘‘স্কুল কিংবা স্কুলের পথ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে কোন ভরসায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাব?’’ শিক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই উদ্বেগ কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়। বেশ কিছু স্কুলের অবস্থা কিন্তু সত্যিই বিপজ্জনক।
গত ১৫ জুলাই ধুলিয়ানের মহব্বতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়-চত্বরে জমা কোমর-সমান জলে খেলতে গিয়ে ডুবে মারা গিয়েছে ওই স্কুল-লাগোয়া বাড়ির বছর আটেকের এক শিশু। ওই ঘটনার পরে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। স্কুল কর্তৃপক্ষও কোনও ঝুঁকি না নিয়ে স্কুলে ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে অবশ্য টনক নড়ে প্রশাসনের। স্কুল চত্বর থেকে জমা জল বের করে দেওয়া হয়। শুরু হয় স্কুলের পঠনপাঠন। শিক্ষার অধিকার আইনে (২০০৯) স্পষ্টই বলা হয়েছে, স্কুলের অবস্থান এমন জায়গায় হতে হবে যাতে বন্যা, ধস কিংবা অন্য কোনও রকম ঝুঁকির সামনে শিশুদের না পড়তে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দুই জেলার বহু পড়ুয়া স্কুলে যাচ্ছে বিপদের ঝুঁকি নিয়েই।

নবগ্রামের নিমগ্রাম শাহ রহমানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উঠোনে ঢুকে পড়েছে পুকুরের জল। যে কোনও সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। অভিযোগ, বিপদের কথা জানিয়ে আতঙ্কিত স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্থানীয় পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসন জানালেও কারও তরফে কোনও সাড়া মেলে নি। ধুলিয়ানের মহব্বতপুর স্কুলের ওই ঘটনার পরে নবগ্রামের অভিভাবক ও গ্রামবাসীরাও দাবি তুলেছেন, পুকুর ঘিরে গার্ডওয়াল তৈরির ব্যবস্থা করুক প্রশাসন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও মানছেন, এমন দাবি খুবই স্বাভবিক। তাঁরাও খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন। ‘‘পড়ুয়াদের সবসময় চোখে চোখে রাখি। কাউকে পুকুরের দিকে যেতে দিই না। তবুও স্কুলের পাশে এমন বিপদ থাকলে ভয় তো করেই। সবসময় মনে হয়, এই বুঝি কিছু ঘটে গেল!’’ বলছেন ওই স্কুলের শিক্ষক সাদেকুল শেখ।
১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বর্তমানে ১৭০। শিক্ষক আছেন ৫ জন। স্থানীয় অভিভাবক আমিনুল ইসলাম জানান, পাড় ভেঙে স্কুলের উঠোনে ঢুকে পড়েছে পুকুর। এখন যা অবস্থা তাতে খেলতে খেলতে একটু আনমনা হলেই পা পিছলে শিশুরা যে কোনও মুহূর্তে জলে পড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি এমন বিপজ্জনক জেনেও হুঁশ নেই প্রশাসনের। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য নাদিরা পরভিনের ছেলেও পড়ে ওই স্কুলে। তিনি বলেন, ‘‘প্রশাসনের সব স্তরে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে?’’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হক জানান, আগে পুকুরে এত জল থাকত না। ২০১২ সালে একশো দিনের প্রকল্পে পুকুরটি সংস্কার করা হয়। তখনই এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে পুকুরের ছবি-সহ তিনি বিষয়টি বিডিওকে জানান। বিডিও গুড়াপাশলা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৎকালীন প্রধানকে স্কুলে গিয়ে বিপদ রুখতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। পরের দিন ওই প্রধান এসে লিখিত ভাবে জানান, বিষয়টি ঠিক হয়নি। পুকুরের পাড় বরাবর একটি গার্ডওয়াল তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় পঞ্চায়েতের তরফে। কিন্তু গার্ডওয়াল আজও তৈরি হয়নি।

এখন অবশ্য স্থানীয় পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসন সকলেই আর্থিক কারণ দেখিয়ে মুখ ফেরাচ্ছেন বলে অভিযোগ স্কুল কর্তৃপক্ষের। নবগ্রামের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক শুভ্রপ্রকাশ ঘটক বলেন, ‘‘গার্ডওয়াল তৈরির ব্যাপারে সর্বশিক্ষা দফতরকে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে টাকা না এলে কিছু করা যাবে না। তবে ওই স্কুলকে বলা হয়েছে স্কুলের নিজস্ব কোনও তহবিল থেকে সম্ভব হলে সে কাজ করতে পারে।’’ নবগ্রামের বিধায়ক সিপিএমের কানাই মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘‘স্কুল কর্তৃপক্ষ লিখিত ভাবে জানালে সমস্যার সমাধান করে দেব।’’

অন্য দিকে, গত একমাস ধরে করিমপুর রামকৃষ্ণপল্লির স্কুল পাড়ার রাস্তায় জল জমে রয়েছে। ওই জমা জল মাড়িয়েই স্কুলে যেতে হচ্ছে পড়ুয়াদের। স্থানীয় বাসিন্দা অসীম লাহিড়ি বলেন, “এটা তো ফি বর্ষার চিত্র। জলবন্দি ওই রাস্তার পাশেই পুকুর আছে। যে কোনও সময় পা পিছলে ওই পুকুরে পড়ে যেতে পারে।’’ সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে যায় থানারপাড়ার পণ্ডিতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোজিৎ হালদার বলেন, ‘‘ওই বর্ষার সময়টা রীতিমতো আতঙ্কে থাকি। সামান্য বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে যায় স্কুল। কমে যায় পড়ুয়াদের উপস্থিতির হারও। অনেক সময় আমরা ঝুঁকি না নিয়ে ছুটি দিয়ে দিতে বাধ্য হই। সমস্যার কথা অবর বিদ্যালয় পরিদর্শককে জানিয়েছি।” স্থানীয় বাসিন্দা তথা অভিভাবক মোক্তার হোসেন জানান, বৃষ্টিতে একই সমস্যা হয় পণ্ডিতপুর সামসেরিয়া উচ্চ মাদ্রাসাতেও। সম্প্রতি ওই জমা জলের কারণে তিনি তাঁর ভাইপোকেও স্কুলে পাঠাননি। সেনপাড়া পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোপাল বিশ্বাস জানান, জমা জলের কারণে বর্ষাকালে স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি কমে যায়।

কৃষ্ণনগরের পল্লিশ্রীতে কবি নজরুল পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী শিউলি সরকার বলে, ‘‘বর্ষাকালে স্কুলে আসতে খুব ভয় লাগে। কোনও কোনও দিন হাঁটু সমান জল ভেঙে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়।’’ ওই স্কুলের প্রায় দেওয়াল ঘেঁসেই রয়েছে পুকুর। বর্ষায় পুকুর উপচে জল চলে আসে স্কুলে। প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ দাস বলেন, ‘‘স্কুলের সামনে জল জমে গেলে পড়ুয়াদের হাত ধরে জল পার করে দিই। পুরসভাকে বলেছি, পুকুরের পাশ দিয়ে পাঁচিল তুলে দিতে। না হলে সবসময় একটা চিন্তা থেকেই যায়।’’ স্থানীয় পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, ‘‘পাম্প বসানোয় ওই এলাকায় আর বেশিক্ষণ জল জমে থাকে না। পুকুরের ধারে পাঁচিলও তৈরি করে দেওয়া হবে।’’এ দিকে, মঙ্গলবার জল তেমন না বাড়লেও স্কুল চত্বরে জল জমে থাকায় সাটুই হাই স্কুল-সহ এলাকার বেশ কিছু স্কুলে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE