Advertisement
১০ মে ২০২৪

তাঁত ডুবে, ক্ষতির আশঙ্কা

তাঁতঘরে হাঁটুজল। বহু তাঁতি ত্রাণ শিবিরে। স্যাঁতস্যাঁতে এই আবহাওয়ায় আটকে যাচ্ছে মাকু। সুতো শুকোচ্ছে না। মাথায় হাত পড়েছে বর্ধমান, নদিয়ার তাঁতিদের। ফি বছর রথের চাকা গড়ালেই তাঁতিপাড়ায় শুরু হয় ব্যস্ততা। শাড়ির পাড়ে নতুন ডিজাইন, জমিতে রঙের নতুন নকশিদারি নিয়ে সময় কেটে যায় হুহু করে।

পুজোর বাজারে এ বার দেখা না-ও যেতে পারে এই সব শাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

পুজোর বাজারে এ বার দেখা না-ও যেতে পারে এই সব শাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
কালনা ও নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

তাঁতঘরে হাঁটুজল। বহু তাঁতি ত্রাণ শিবিরে। স্যাঁতস্যাঁতে এই আবহাওয়ায় আটকে যাচ্ছে মাকু। সুতো শুকোচ্ছে না। মাথায় হাত পড়েছে বর্ধমান, নদিয়ার তাঁতিদের। ফি বছর রথের চাকা গড়ালেই তাঁতিপাড়ায় শুরু হয় ব্যস্ততা। শাড়ির পাড়ে নতুন ডিজাইন, জমিতে রঙের নতুন নকশিদারি নিয়ে সময় কেটে যায় হুহু করে। পুজোর বাজার ধরা চাই! কিন্তু এ বার তাঁতশিল্পীর ভাগ্যের নকশা বদলে দিয়েছে বৃষ্টি। ধাক্কা লাগতে চলেছে পুজোর বাজারে।

বর্ধমান জেলার অর্থনীতিতে কৃষির পরেই তাঁত। ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড়, শ্রীরামপুর, দাঁইহাট, নসরতপুর বা কাটোয়ায় লক্ষাধিক তাঁতশিল্পীর বাস। ও দিকে, নদিয়ার শান্তিপুর, ফুলিয়া বা নবদ্বীপও তাঁতের রমরমা। পুজোর মাস চারেক আগে চূড়ান্ত ব্যস্ততা শুরু হয়। পুজোয় তাঁতের শাড়ির জোগান দিতে সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রামে কাজ করেন উত্তরবঙ্গের বহু তাঁতশ্রমিকও।

এ বার জুলাই মাসের প্রথম থেকে একের পর এক নিম্নচাপের ধাক্কায় তাঁতঘর স্যাঁতস্যাঁতে। তাঁতের মাকু এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টানতে গেলে যন্ত্রে সুতো জড়িয়ে যাচ্ছে। দিন চারেক আগের বৃষ্টিতে কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়ার অজস্র তাঁতঘরে জল ঢুকেছে। তাঁত যন্ত্রের নীচে কোথাও গোড়ালি-ডোবা জল, কোথাও হাঁটুজল। ফলে কাজ বন্ধ।

পূর্বস্থলী ১ ব্লকের গোয়ালপাড়া গ্রামে বেশির ভাগ শিল্পী বালুচরি শাড়ি বোনেন। তাঁতশিল্পী হুমায়ুন শেখ বললেন, ‘‘এ বার অনেকেই মহাজনের বরাত অনুযায়ী কাপড় দিতে পারবেন না।’’ টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির শিল্পী পিয়ার শেখ, আসান শেখ, মন্টু শেখদের বক্তব্য, ‘‘জুলাইয়ের শুরু থেকে তাঁত বন্ধ। এখন তো তাঁতঘরে ঢোকাই যাচ্ছে না। পুজোর ঠিক আগে এত বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে, ভাবিনি।’’ পূর্বস্থলী ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক জানান, এলাকার প্রায় ২৫ হাজার তাঁতিদের একটা বড় অংশকে সরানো হয়েছে ত্রাণশিবিরে।

নদিয়ার শান্তিপুরের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তাঁতের সঙ্গে যুক্ত। টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে সব ধরনের শাড়ি উৎপাদন বন্ধ সেখানে। ফুলিয়ার অন্যতম শাড়ি উৎপাদক বীরেন বসাক বলেন, “কুড়ি বছরে এমন বর্ষা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। আমার নিজের বাড়িতে কোমর জল। প্রচুর সুতো ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”’

শান্তিপুর, ফুলিয়া, নবদ্বীপে ছবিটা একই রকম। নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জের সুবল দেবনাথ, প্রদীপ দেবনাথেরা বলেন, ‘‘শ্রাবণে এমন অবস্থা কোনও দিন দেখি নি। আমাদের এখানে বন্যা হয় সাধারণত ভাদ্রের শেষ বা আশ্বিনের শুরুতে। তত দিনে কাজ অনেকটা এগিয়ে যায়।’’ পুজোর শাড়ি বোনার জন্য অগ্রিম টাকা বা সুতো নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকের বাড়িতেই জল। কেউ হয়তো এখনও ত্রাণ শিবিরে। বিদ্যুৎচালিত তাঁতে বোনা শাড়িও এই অবস্থায় শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন তাঁতিরা।

তাঁতিদের আক্ষেপ, এত দিন টানা ভিজে বাতাসে সুতোর মাড় থাকছিল না। রোদ না থাকায় রঙ বসল কি না, এত দিন সেটাই বোঝা যাচ্ছিল না। কাপড় তৈরির পর মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে ভাঁজ করা, কিছুই সম্ভব নয় রোদ না উঠলে। শাড়ি তৈরি হয়ে পড়ে থাকবে। বাজারে বিক্রি করা যাবে না। এত দিনে রোদ বেরোনোয় ফের কাজের আশা জেগেছে। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। তাঁতিদের আক্ষেপ, ‘‘কোথায় এখন দিনে একটার বদলে দু’টো শাড়ি বুনে বেশি রোজগার করব, তা নয় ত্রাণের আশায় বসে থাকতে হচ্ছে।’’ প্রমাদ গুনছেন কলকাতার শাড়ি ব্যবসায়ীরাও। বিধান সরণির ডালিয়ার কর্ণধার অঞ্জনকুমার দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের বেশির ভাগ তাঁতের শাড়ি আসে ফুলিয়া থেকে। আমরা যথেষ্ট চিন্তায়। কারণ তাঁতের কাপড়ে অল্প জল পড়লেই নরম হয়ে যায়, যা শাড়ির জন্য ক্ষতিকারক। ইতিমধ্যেই খবর পাচ্ছি, জল পড়ে দাগ হয়ে যাওয়ায় অনেক সাদা শাড়ি বাদ দিতে হচ্ছে তাঁতিদের।’’ কলেজ স্ট্রিটের আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের তরফে দিব্যেন্দু সাহা বলেন, ‘‘বর্ষায় এ সমস্যাটা নতুন নয়। তাই পুজোর স্টক আমরা বর্ষার আগেই তুলে রাখি। সমস্যা পোহাতে হচ্ছে তাঁতিদের। ওঁদের হয়তো পুজোর মুনাফাটা কম হয়ে যাবে। আমাদের এখানে ভ্যারাইটিতে কোনও অসুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না।’’

বছরভর বাংলার তাঁতিদের নিয়েই কাজ করেন ফ্যাশন ডিজাইনার সৌমিত্র মণ্ডল। তিনি চিন্তিত ‘অটম কালেকশন’ নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ফুলিয়া, উদয়নারায়ণপুর ও আমতার তাঁতশিল্পীরা আমার কাজ করেন। তাঁরা খুব সমস্যায় রয়েছেন। তার থেকেও চিন্তার, সুতোগুলো খুব দামি। এই সুতোয় অল্প জল পড়লেই তা পচে যায়। ফলে আর্থিক ক্ষতিও অনেকটা হচ্ছে। এর পরে আর যদি বৃষ্টি না-ও হয় তা হলেও ওঁরা কাজ শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। পুজোর বরাত ওঁরা কতটা সামাল দিতে পারবেন কে জানে!’’ অঞ্জনবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘প্রচুর সুতো ভিজে গিয়েছে শুনছি। সে দিক থেকে আমাদের আর্থিক ক্ষতিও অনেক। তবে একটাই আশা, পুজো এ বার একটু দেরিতে। বর্ষার পরে হয়তো পরিস্থিতি খানিকটা সামাল দেওয়া যাবে। ’’ গড়িয়াহাটের ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির পরিচালনমণ্ডলীর তরফে রতনকুমার সাহা বলেন, ‘‘শাড়ি বোনা ও আনার ক্ষেত্রে সাময়িক কিছু সমস্যা হচ্ছে, তবে তাতে পুজোর বাজারে খুব ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE