Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
এনআরএস-হত্যা

থানা আর লালবাজারের আলাদা তদন্তে বিভ্রান্তিই

এক শহর, এক ঘটনা, পুলিশও এক। অথচ তাদের তদন্তকারী দল দু’টো! তারা কাজও করছে আলাদা আলাদা। ফল যা হওয়ার তা-ই। সমন্বয়ের অভাবে পুরোটাই মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়! এনআরএসের ছাত্রাবাসে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় এক দিকে যেমন কলকাতা পুলিশের এন্টালি থানা তদন্ত করছে, অন্য দিকে করছে লালবাজারের গোয়েন্দা শাখাও। পুলিশের একাংশই বলছেন, দু’টি দল স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করায় হামেশাই সমন্বয় থাকছে না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

এক শহর, এক ঘটনা, পুলিশও এক। অথচ তাদের তদন্তকারী দল দু’টো! তারা কাজও করছে আলাদা আলাদা। ফল যা হওয়ার তা-ই। সমন্বয়ের অভাবে পুরোটাই মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়!

এনআরএসের ছাত্রাবাসে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় এক দিকে যেমন কলকাতা পুলিশের এন্টালি থানা তদন্ত করছে, অন্য দিকে করছে লালবাজারের গোয়েন্দা শাখাও। পুলিশের একাংশই বলছেন, দু’টি দল স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করায় হামেশাই সমন্বয় থাকছে না। এমনিতেই এনআরএস-কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় তদন্ত গতি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ। তার উপরে তদন্তকারীদের তরফে এ হেন তাল-মিলের অভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ। বস্তুত এনআরএস-কাণ্ডের তদন্ত গুলিয়ে দিতেই এ ভাবে দু’টো আলাদা দল নামানো হল কি না, লালবাজারের অন্দরে সে সন্দেহও মাথা চাড়া দিয়েছে।

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের বয়েজ হস্টেলে ১৬ নভেম্বর কাকভোরে গণপিটুনিতে কোরপান শা নামে এক বহিরাগত যুবকের মৃত্যু হয়। এন্টালি থানা খুনের মামলা রুজু করে তদন্তে নামে। ১৭ তারিখে তারা এনআরএস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে হস্টেলের আবাসিকদের নাম, ঠিকানা ও ছবির তালিকা চায়। এন্টালি থানার অফিসারেরা বিভিন্ন সময়ে হস্টেলে গিয়ে কর্মী-আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ দিকে ঘটনার দিন লালবাজার থেকেও এক গোয়েন্দা-অফিসারকে ওখানে পাঠানো হয়। ১৯ তারিখে পৌঁছে যায় লালবাজারের পুরোদস্তুর গোয়েন্দা-দল। আপাতত লালবাজারের গোয়েন্দারাও নিজেদের মতো করে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন অথচ এন্টালি থানাকে দায়িত্ব ছাড়তে বলা হয়নি। তাই তারাও যথারীতি তদন্ত করছে। যেখানে লোকাভাবের কারণে বিভিন্ন তদন্ত সামাল দিতে পুলিশ হিমশিম খায়, সেখানে একই ঘটনায় দু’টি দলকে ব্যস্ত রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে স্বভাবতই পুলিশ মহলে প্রশ্ন উঠেছে। খুনের তদন্ত তো সাধারণত লালবাজারের হোমিসাইড শাখাই (বিশেষজ্ঞ অফিসারদের নিয়ে গড়া) করে থাকে। এখানে ব্যতিক্রম কেন?

পুলিশের উঁচুতলার কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা মেলেনি। এক কর্তার কথায়, “এনআরএস-কাণ্ডের তদন্তভার এখনও এন্টালি থানার হাতেই। হোমিসাইড নিছক সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।” যা শুনে এন্টালি থানার এক অফিসারের মন্তব্য, “আমাদের উপরে ভরসা না-থাকলে পুরো দায়িত্বটাই লালবাজার নিয়ে নিক না! আমরা বেঁচে যাই! এমনিতেই কাজের তুলনায় লোক কম।” আর খাস লালবাজারের এক গোয়েন্দা-অফিসারের পর্যবেক্ষণ, “কেউ হয়তো চাইছে না যে, তদন্ত দ্রুত শেষ হোক। অভিযুক্তেরা চিহ্নিত হোক। তাই এমন বিচিত্র সিদ্ধান্ত।”

বস্তুত এনআরএসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মূলত যাঁদের দিকে আঙুল, সেই হবু চিকিৎসকদের বাঁচাতে শাসকদলের তৎপরতার অভিযোগ তুলেছেন চিকিৎসকদেরই একাংশ। ওঁদের মতে, তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেলের কিছু নেতা পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তদন্ত পণ্ড করার চেষ্টায় রয়েছেন। রবিবার পুলিশ অফিসারদেরও কারও কারও মুখে সেই ‘অদৃশ্য’ নিয়ন্ত্রকদের ভূমিকার কথা শোনা গিয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেল এখানে হস্তক্ষেপ করতে যাবে কেন?

লালবাজারের অন্দরের খবর: অভিযোগের তির যে সব হবু ডাক্তারের দিকে, তাঁদের অনেকে শাসকদলের ছাত্র নেতা। স্বভাবতই তাঁদের গায়ে আঁচ ঠেকাতে দল সক্রিয় হয়েছে। লালবাজারের এক অফিসারের কথায়, “ধরপাকড় এড়াতেই গোয়েন্দা বিভাগের হাতে দায়িত্ব পুরোপুরি ছাড়া হচ্ছে না। তদন্ত থমকে থাকছে। আবাসিকদের জেরা করার ক্ষেত্রেও দু’টো দল আলাদা ভাবে কাজ করছে কেন, মাথায় ঢুকছে না।” পুলিশ-সূত্রে জানা যাচ্ছে, ডিসি (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে গোড়া থেকে এনআরএস নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। এন্টালির অফিসারদের তিনি দ্রুত তদন্ত শেষের নির্দেশ দেন। থানা সেই মতো এগিয়েছে, আবাসিকদের নাম-ঠিকানা-ছবি চেয়ে বারবার তাগাদা দিয়েছে এনআরএস-কর্তৃপক্ষকে। তাতেই নেতারা প্রমাদ গুনেছেন। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য সেলের মাথারা ডিসি-র সক্রিয়তাও ভাল চোখে দেখেননি বলে লালবাজার-সূত্রের ইঙ্গিত।

শাসকদলের ‘অসন্তোষের’ মাসুল লালবাজারকে দিতে হবে না এমন গ্যারান্টিও নেই। আলিপুর থানায় তৃণমূল সমর্থকদের হামলাবাজির পরে অভিযুক্ত মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের ধরতে তৎপর হয়েছিলেন ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা। তদন্তকারী অফিসারও বদলে দেন তিনি। সূত্রের খবর, সেই থেকে শাসকদলের একাংশ ওঁকে বদলি করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ বার ডিসি (ইএসডি)-র ক্ষেত্রেও একই তৎপরতা শুরু হবে বলে লালবাজারের অনেকের আশঙ্কা। “হোমিসাইডকে এনে এন্টালি থানার দায়িত্ব প্রচ্ছন্ন ভাবে কমিয়ে এই মামলায় ডিসি-র ক্ষমতাও কিছুটা খর্ব করা হয়েছে।” বলছেন কলকাতা পুলিশের এক অফিসার।

তৃণমূল স্বাস্থ্য সেলের মাথারা কী বলছেন? ওঁদের বিশেষ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সেলের অন্যতম নেতা তথা তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজি ফোন ধরেননি। এসএমএসের জবাবও দেননি। সেলের আর এক নেতা তথা রাজ্য আইএমএ-র সম্পাদক শান্তনু সেন ফোন ধরলেও এনআরএস-কাণ্ড নিয়ে কিছু বলবেন না জানিয়ে কেটে দিতে দেরি করেননি।

কোরপানের স্ত্রীর কাছে মানবাধিকার সংগঠন

এনআরএস হাসপাতালের ছাত্রাবাসে কোরপান শা’কে মিটিয়ে মারা ঘটনায় অভিযুক্তদের পুলিশ ইচ্ছা করেই ধরছে না বলে জানালেন এপিডিআর-এর সদস্যরা। রবিবার সংগঠনের চার সদস্যের এক প্রতিনিধি দল উলুবেড়িয়ার বানীতবলা শা-পাড়ায় কোরপানের বাড়িতে আসেন। ঘটনার সাত দিন পরেও কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা। অবিলম্বে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার না করা হলে তাঁরা দেশ জুড়ে আন্দোলন সংগঠিত করবেন বলে সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে। এমনকী পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলাও করা হবে বলে জানিয়ছেন ওই প্রতিনিদিরা। দোষীদের যাতে ধরতে না হয় সে জন্য পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতর ডাক্তারি ছাত্রদের ‘পরীক্ষা আছে’ বলে যে কারণ দেখাচ্ছে, তাকে অজুহাত বলে উল্লেখ করে সংস্থার রাজ্য সম্পাদিকা রাংতা মুন্সি বলেন, “বিশ্বের কোনও আইনে এই ব্যবস্থা নেই। দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে, কারণ মৃতের পরিবার সহায়-সম্বলহীন।” তিনি জানান, বিষয়টি তাঁরা মানবাধিকার কমিশনে জানাবেন। কোরপানের স্ত্রী আরজিনা প্রতিনিধিদের কাছে এ দিন দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। পাশাপাশি স্বামী না থাকায় তাঁদের পরিবার যাতে বাঁচে তা দেখার অনুরোধও করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nrs murder korpan shah two investigation team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE