দুই বাড়ির মাঝের রাস্তায় এ ভাবেই চলছে অবৈধ নির্মাণ। ছবি: উৎপল সরকার।
সাধারণ চাকুরিজীবী গৃহস্থ হোন বা চিকিৎসক, প্রোমোটার হোন বা শিল্পোদ্যোগী, মামুলি সিভিক পুলিশ হোন বা উর্দিধারী ট্র্যাফিক কনস্টেবল। কারও রেহাই নেই! এমনকী, রাজ্য তথা দেশের গৌরব বাড়ানো খেলোয়াড়েরও!
শাসকদলের নেতা-কর্মীদের ‘জলুমবাজি’র নালিশ এসেছে ও আসছে সমাজের সর্বস্তর থেকেই। তালিকায় নবতম সংযোজন রাজ্যের দুই নামী ক্রীড়াবিদ, যাঁদের বাড়ির রাস্তা বন্ধ করে অবৈধ নির্মাণের জন্য আঙুল উঠছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, তৃণমূলের দলীয় অফিস গড়তে এ হেন বিধিভঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর সরাসরি মদত দিচ্ছেন। এবং প্রতিকারের আশায় দরবার করতে গিয়ে তাঁদের শুনতে হয়েছে, দরকারে ওই রাস্তায় জলের কলও নাকি বন্ধ করে দেওয়া হবে!
ঘটনাস্থল: দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকার রাজডাঙা শরৎপল্লি। জায়গাটা কলকাতা পুরসভার ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। আর ভুক্তভোগী দুই ক্রীড়াবিদ হলেন দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার নিশা মোহতা ও এশিয়ান গেমসের সোনাজয়ী অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিক।
রাজডাঙা শরৎপল্লির বিবি ব্লকে পাশাপাশি দু’জনের বাড়ি। একটি সম্পূর্ণ, অন্যটি নির্মীয়মাণ। সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ওঁরা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ওই জমি পেয়েছিলেন, কেএমডিএ মারফত। দেশের অন্যতম সেরা মেয়ে দাবাড়ু নিশা বছরখানেক হল বাড়ি বানিয়ে সপরিবার বসবাস করছেন। ‘সোনার মেয়ে’ পিঙ্কির জমিতে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছে, নতুন ঠিকানায় পাকাপাকি ভাবে উঠে আসবেন।
কিন্তু গোল বেঁধেছে দুই বাড়ির মাঝের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। দশ ফুটের পিচ রাস্তাটি পুরোপুরি আটকে দিয়ে সেখানে মাথা তুলছে একটা দোতলা ইমারত, যার কোনও আইনি বৈধতা নেই বলে অভিযোগ। পিঙ্কি-নিশার বাড়ির পাঁচিলের গা ঘেঁষে উঠে গিয়েছে বড় বড় পিলার। গিয়ে দেখা গেল, প্রথম তলার ঢালাই চলছে জোরকদমে। নির্মাণস্থলে একটা ব্যানারও টাঙানো। তাতে লেখা— ‘রাজডাঙ্গা শরৎপল্লি শন্তিপার্ক অধিবাসীবৃন্দ।’ তামাম তল্লাট ঢুঁড়েও এমন কোনও সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সূত্রের ব্যাখ্যা, ঘটনাটা মি়ডিয়ার নজরে এসেছে আঁচ পেতেই নির্মাতারা তড়িঘড়ি অলীক নামে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে!
এত সতর্কতা কেন? বাড়িটায় কী হবে? ঢালাইকর্মীদের সঙ্গে থাকা এক যুবক সাফ বললেন, ‘‘তৃণমূলের পার্টি অফিস হচ্ছে।’’ এর বেশি উনি মুখ খুলতে চাননি। ‘‘আমাদের নেতা বাচ্চুদার সঙ্গে কথা বলুন। সব জানতে পারবেন।’’— পরামর্শ দিলেন তিনি।
বাচ্চুবাবুর বাড়ি উল্টো দিকেই। অনেক খোঁজ করেও তাঁর দেখা মেলেনি। তবে ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা বরো কমিটির চেয়ারম্যান সুশান্তকুমার ঘোষ কার্যত অবৈধ নির্মাণের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। এবং যা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা বেশ চমকপ্রদ। কী রকম?
টেলিফোনে এ বিষয়ে প্রশ্ন শুনে সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘ওখানে আমাদের পার্টি অফিস হচ্ছে না। অন্য জিনিস হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখছি, কী হচ্ছে।’’ যা-ই হোক না কেন, মানুষের যাওয়া-আসার রাস্তা রুখে বেআইনি নির্মাণ চলছে কী ভাবে?
কাউন্সিলরের ব্যাখ্যা, ‘‘ওটা পুরসভার জমি নয়। কেএমডিএ-র বাড়তি জায়গা। সেখানে হচ্ছে।’’ কিন্তু সেখানেও কি নিয়ম না-মেনে বাড়ি তোলা যায়? সুশান্তবাবুর উত্তর, ‘‘বললাম তো, খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ ফোন রেখে দেন কাউন্সিলর। পরে জিজ্ঞাসা করা হয়, জলের সমস্যা থাকায় রাস্তাটির কলে বহু লোক জল নিতে আসেন। আপনি নাকি বলেছেন কল তুলে দেবেন?
‘‘হ্যাঁ, বলেছি।’’— সপাট জবাব সুশান্তবাবুর। তাঁর যুক্তি, ‘‘সবার বাড়িতে জলের লাইন আছে। তা হলে রাস্তায় কল কেন? ও সব বাম জামানায় বসেছে। এ বার তুলে দেব।’’
পুর-প্রতিনিধির অবস্থান দেখে প্রতিবাদীরা হাল ছেড়েছেন। পুর-কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের কাছে যাওয়ার কথাও ভাবছেন না। ‘‘রুলিং পার্টি জড়িত দেখলে পুলিশ তো সুরাহা কিছু করবেই না, উল্টে রাতে বাড়িতে হামলা হবে। তখন কে দেখবে?’’— পাড়ার পুজোমণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এক বাসিন্দা। টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি নিতে নিশা এখন দিল্লিতে। তাঁর বাবা, পেশায় শিক্ষক নির্মলকুমার মোহতার বক্তব্য, ‘‘সবাই বলছে, কাউন্সিলরের লোকজনই বাড়ি তুলছে। তা হলে আর কাকে বলব?’’ পড়শি মনোজ দাসের আক্ষেপ, ‘‘পুরো ওয়ার্ড জুড়েই বেআইনি বাড়ির রমরমা। ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না!’’
পিঙ্কির কী প্রতিক্রিয়া?
পুরো ঘটনা শুনে পিঙ্কি বলেন, ‘‘এ সব হচ্ছে নাকি? জানি না তো! গিয়ে খোঁজ নেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy