Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

নবাবি খোয়াব অথবা নিরেট কাহিনি

ইমারত নির্মাণে সম্রাট শাহজাহানের পর আরও অনেকের সঙ্গে যাঁর নাম আসতে পারে, তিনি অবধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। ফারাক হল কারও প্রাসাদ টিকে থাকে হাজার বছর, কারও দু’দিনেই ধুলোয় মিশে যায়। সেই রকমই অতীতের শান-শওকত, জৌলুস ধূলিকণায় মিশে যাওয়া কঙ্কালসার শহর নবাবের মেটিয়াবুরুজ। বাতাসে গোলাপ-খুশবু নেই, কাটা সুতো উড়ে বেড়ায়।

শাহীন আখতার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০২:৩৫
Share: Save:

ইমারত নির্মাণে সম্রাট শাহজাহানের পর আরও অনেকের সঙ্গে যাঁর নাম আসতে পারে, তিনি অবধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। ফারাক হল কারও প্রাসাদ টিকে থাকে হাজার বছর, কারও দু’দিনেই ধুলোয় মিশে যায়। সেই রকমই অতীতের শান-শওকত, জৌলুস ধূলিকণায় মিশে যাওয়া কঙ্কালসার শহর নবাবের মেটিয়াবুরুজ। বাতাসে গোলাপ-খুশবু নেই, কাটা সুতো উড়ে বেড়ায়। কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে বারুদগন্ধময়।

সিপাহি বিদ্রোহের পর হুগলির তীর ধরে রাতারাতি গড়ে ওঠা মেটিয়াবুরুজ আজ কলকাতারই অংশ। শোনা যায়, ১৮৫৬ সালে অবধ রাজ্য ইংরেজরা কব্জা করলে ওয়াজিদ আলি শাহের সঙ্গে বা পরে চল্লিশ হাজারেরও বেশি লোক লখনউ ছাড়ে। সে দিন লখনউ আর লখনউ ছিল না, মেটিয়াবুরুজই হয়ে ওঠে লখনউ। সেই জবান, সেই মুশায়রা, সেই রংমহল, সেই ঘুড়ি-ওড়ানো পায়রাবাজি, আমোদ-ফুর্তি। শিয়া নবাবদের ইমামবাড়া, কারবালা, মর্সিয়া, জাঁকজমকপূর্ণ তাজিয়া। কবি-নর্তক-গায়ক-বাদ্যকারদের মতো মশহুর ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি অনেক সাধারণ পেশার লখনউওয়ালাও সে দিন পাড়ি জমিয়েছিলেন মেটিয়াবুরুজ। তাঁরা কে কোথায় হারিয়ে গেছেন। দৃশ্যমান আছেন শুধু দর্জিকুল। দাপটের সঙ্গেই আছেন। তাঁদের তৈরি রেডিমেড পোশাকের চালান যায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য-সহ পশ্চিম এশিয়ার কুয়েত, সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশে।

বুধবার সকাল। কারবালা রোডের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি। দু’পাশের দোকানপাটের শাটার নামানো। রাস্তাটাও প্রায় জনশূন্য, সুনসান। “এ রাস্তা দিয়ে শনি-রবি হাঁটতে পারবেন না,” সঙ্গের সাংবাদিক বন্ধু বললেন। “সে দু’দিন রেডিমেড পোশাকের পাইকারি হাট বসে। লোক গিজগিজ করে সারাটা পথ।”

বেশ খানিকটা পর কালো হন্ডা থেকে নামলেন এক ব্যবসায়ী। কারবালা রোডের একটি নির্মীয়মাণ ভবনের এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললেন, “এটি আসলে সেবামূলক কাজ। যে গরিব মেয়েছেলেরা খাটাখাটনি করে, লাভ যদি হয় দশ টাকা, তাদের আট টাকা দিয়ে দু’টাকা থাকে।” বাংলাদেশে বিএমডব্লিউ হাঁকান, এমন মালিকদের মুখেও পাকে-বিপাকে সমাজসেবার দোহাই। প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ রফতানি আয়ের বাংলাদেশ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এখানকার তুলনা চলে না। দাদন নিয়ে অনেকটা কুটিরশিল্পের ধাঁচে কাজ হয় এখানে। তবু উৎপাদন ব্যবস্থায় বেশ কিছুটা সাযুজ্য রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের শতকরা পঁচাশি জন মেয়ে। মজুরি যৎসামান্য। মেটিয়াবুরুজে মাসিক সাত-আটশো টাকায় সুরাইয়া, দিলরুবার মতো কিশোরীরা তৈরি জামাপ্যান্ট থেকে বাড়তি সুতো কাটার কাজ করে। কাটিং মাস্টার, দর্জির মাইনে দেড়-দু’হাজার। নিডল ভেঙে যাওয়ায় মেশিন ছেড়ে মেঝেতে বসে কাঁচি দিয়ে সুতো কাটছিলেন গার্ডেনরিচের আয়েশা খাতুন। বছর তিরিশের হাসিখুশি মেয়ে। বললেন, সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। রোজ ন’টা-ছ’টা কাজ। ওভারটাইম নেই। কাটিংয়ের অণিমা ঘোষও একই কথা বললেন।

ওভারটাইম ছাড়া বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কল্পনাও করা যায় না। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত হাই ভোল্টেজের আলোয় কাজ চলে। তখন বড় বড় কাচের জানালার হাইরাইজ বাড়িগুলোকে মনে হয় স্পেসশিপ, এক ঝাঁক মলিন বস্ত্রের মেয়ে নিয়ে বুঝি শূন্যে উড়বে। গেল-বছর এ রকম একটি আটতলা ভবন ধসে প্রায় এগারোশো শ্রমিক মারা যান। এত বড় মানব-সৃষ্ট বিপর্যয়! মালিক জেল খাটছে। আহতদের চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির দাবিতে এখনও দেন-দরবার, আন্দোলন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।

সামনে ভোট। অনিবার্য ভাবে প্রসঙ্গটি চলে আসে আয়েশা খাতুনের সঙ্গে কথোপকথনে। “আমার ভোটার আইডি কার্ড নেই”, বলছিলেন আয়েশা। “তার জন্য প্রমাণাদি লাগে। স্কুলে পড়িনি, হাসপাতালেও জন্ম হয়নি, বার্থ সার্টিফিকেট নেই। রেজিস্ট্রি করেও বিয়ে হয়নি।” আয়েশার গ্রামের বাড়ি বর্ধমান জেলায়। ওখানে যারা মেলা টাকাপয়সা দিয়ে বিয়ে দেয়, তারা ভয়ে রেজিস্ট্রি করে। যদি মেয়ের কোনও সমস্যা হয়! বিয়ের প্রুফ থাকা চাই তো। বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইন যেমন, এখানকার মুসলিম আইনও ইংরেজ জমানার। তাই অনেকেই ‘ফুলবউ’-এর মতন মুখে তালাক, হিলা বিয়ের দুর্ভোগ পোহান। মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছিল আকরা রোডের গাজিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শেখ আরিফ হোসেনের সঙ্গে। উঁচু সিলিংয়ের দ্বিতল বাড়ি। সকালে বসে মেয়েদের মাদ্রাসা। এগারোটা থেকে কো-এডুকেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। “এটি মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তি,” বলছিলেন শেখ আরিফ। “বকরি ঈদের চামড়ার টাকা, জাকাতের পয়সা দিয়ে মেয়েদের এ রকম তিনটি মাদ্রাসা চলে। এখন সরকার থেকে কিছু পাওয়া যায়।” নিউ স্কিমে মাদ্রাসায় সব কিছুই পড়ানো হয়, সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা। তা ছাড়া, স্কুলেও মেয়েদের শিক্ষার হার ছেলেদের চেয়ে ভাল, জানালেন শেখ আরিফ। এটি ব্যবসায়ী এলাকা। ছেলে সেভেন-এইট পাশ দিলে বাবা তাকে নিজের ব্যবসায় ভিড়িয়ে দেন। শেখ আরিফও নিজের বি এসসি পাশ ছেলেকে কাপড়ের ব্যবসায় নামিয়েছেন। এ কাজে রোজগারপাতি বেশ।

রোজগারের হাতছানিতে প্রায় কুড়ি বছর আগে মেটিয়াবুরুজ আসেন মুর্শিদাবাদের জাকির হোসেন। মাধ্যমিক দিয়ে চাকরি জুটছিল না। এখানে টিউশনি করতে করতে ওস্তাগরের কাছে কাটিং-সেলাই-এমব্রয়ডারির হাতেখড়ি। বর্তমানে সিনিয়র কাটিং মাস্টার। রোজগার মন্দ নয়। ঘর ভাড়ার ঝুটঝামেলাও নেই। খান, ঘুমোন কারখানায়। জাকির হোসেন মালের স্যাম্পল দেখে ফর্মা তৈরি করছিলেন মেঝেতে বসে। ওখানেই হাত-আয়নায় খেউরি সারলেন। কাছেই কেরোসিনের স্টোভে মাংস রান্না হচ্ছে। কারখানার ওস্তাগর-মালিক বাদে সবাই মুর্শিদাবাদি। একে অন্যের চাচা-মামা-ভাগ্নে বা স্রেফ পড়শি। কেউ লম্বা ঝুলের কুঁচিদার ফ্রক বানাচ্ছেন। মেশিনে জরি-সুতোর ফুলেল নকশা ফোটানো হচ্ছে কামিজের কিনারায়, হাতায়, গলায়। নির্বাচনের দিন ছুটি। সবাই দল বেঁধে মুর্শিদাবাদ যাবেন ভোট দিতে।

দুপুরের ঠা-ঠা রোদ্দুরে ইমামবাড়ার ভেতরটা শীতল, আরামদায়ক। থেকে থেকে আতর-আগরবাতির মৃদু সুবাস নাকে আসে। কিন্তু কী মলিন, ক্ষয়িষ্ণু সব কিছু! বিবর্ণ ঝালর, আসন-বসন। চাঁদির উজ্জ্বলাও ফুরিয়ে গিয়েছে। রাতে রঙিন শেডের বাতিগুলো জ্বলে উঠলে বা আশুরার দিন যখন তাজিয়া ওঠানো হয়, তখন হয়তো ঝিকমিক করে ইমামবাড়া। তখন হয়তো শৌখিন নবাবের আত্মাটাও ফুর্তিতে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা হলঘরে ঢোকার মুখে জরিদার লালশালু ঢাকা রওজাটা নবাবের। আর আছে উত্তরসূরিদের কবর হলঘর, অলিন্দের চৌকো মোজাইয়ের নীচে। গুপ্তধনের মতো সংরক্ষিত। নবাব খানদানের কন্যা বা বিবি-বেগমদের কবরের হদিস দিতে পারলেন না ইমামবাড়ার খাদেম।

বিনা রক্তপাতে তাজ-তখত ছাড়ার কালিমা যাঁর গায়ে, সেই নবাবের পরিবারের দু’জন লড়াকু নারী আজ প্রায় বিস্মৃত। ভারতবর্ষে দেহ রাখলে পবিত্র এ ইমামবাড়ায় তাঁদের ঠাঁই হত কি না, কে জানে। সে দুজনের এক জন ওয়াজিদ আলি শাহের জননী জনাবে আলিয়া মালকা কিশোয়ার। তিনি অবধ রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য বিলেত গিয়ে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন। ব্যর্থ হন খানিকটা নবাবের দোষে। ভগ্নহৃদয় বেগম হজপালন করতে চাইলেন। তাতে বিধি বাম। মক্কা যাওয়া হল না। পথে মৃত্যু হলে ফ্রান্সের এক মসজিদ চাতালে গোর হয় মালকা কিশোয়ারের। অন্য জন ওয়াজিদ আলি শাহের বেগম হজরত মহল। সিপাহিরা বিরজিস কদরকে অবধের সিংহাসনে বসালে তিনি নাবালক পুত্রের মুখতার বা প্রতিনিধি হন। রক্তঝরা, অনিশ্চিত দিনগুলোতে হজরত মহলই ছিলেন অবধের কান্ডারি। তা রাজ্য কি যুদ্ধ চালনায়। ইংরেজ সৈন্য লখনউয়ে ঢুকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে বেগম সীমান্ত পেরিয়ে সপুত্র আশ্রয় নেন নেপালে। প্রবাসে আর্থিক অনটনে কাটে বাইশটা বছর, তবু ব্রিটিশ রাজের আত্মসমর্পণের ডাকে সাড়া দেননি। কাঠমাণ্ডুর হিন্দুস্তানি মসজিদের চাতালে শায়িত আছেন সিপাহি বিদ্রোহের বীরাঙ্গনা বেগম হজরত মহল।

চার দিকে যখন যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, মেটিয়াবুরুজ তখন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের লীলাক্ষেত্র। ১৮৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিজ হাতে গড়া মেকি সাম্রাজ্যে চোখ বুজলেন নবাব। নবাবের উত্তরাধিকারীদের পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দেওয়ার নামে ইংরেজ সরকার সিন্ডিকেট বানাল। নিলামে উঠল প্রাসাদ, বাগিচা, চিড়িয়াখানা। খিদিরপুর পর্যন্ত বিশেষ ট্রাম নাকি চালু হয়েছিল তাঁর জন্য। বছর না গড়াতে এমন ভাবে সব শেষ হল, যেন তা কোনও দিন ছিলই না। কবি নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের ভাষায়, ‘খোয়াব থা জো কুছ ভি দেখা, জো সুনা আফসানা থা।’ মেটিয়াবুরুজের ইতিবৃত্তও তাই। এ খোয়াব-ই। বা নিরেট কাহিনি।

ইমামবাড়ার বাইরে পা ফেললে কাপড়-সুতো-সেলাই মেশিনের রুটি-রুজির বাস্তব জগৎ। আসন্ন ভোটের চুলচেরা হিসেব চলছে নিভৃতে। কারবালা রোডে জোর গুজব পাড়ার ডন অজমের শরিফ গিয়েছেন। তা হলে তো বোমা ফাটিয়ে একতরফা ভোট হবে। এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওস্তাগর-কারখানার মালিক সাইফুল ইসলামের। কারখানায় নানা জাতের লোককে কাজ দিয়ে কিছুটা হলেও বেকার সমস্যা নিরসন করেছেন। পাঁচ বছর পর ভোট হচ্ছে। সিল মারতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে, যেন ভোটটার ক্ষতি না হয়। তা কী রকম জিজ্ঞাসা করলে জটিল এক অঙ্ক কষেন সাইফুল। বলেন, “দেখুন, কেন্দ্রে তো হয় বিজেপি, না হয় কংগ্রেস সরকার গড়বে। তাই কংগ্রেসকে ডাইরেক্ট মারা দরকার, যাতে ভোটটা কাজে লাগে। তা যদি সম্ভব না হয়,” সাইফুল আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, “সিপিএম যদি কংগ্রেসকে সাপোর্ট করে, সিপিএম’কে দেওয়া দরকার আছে। তৃণমূল ভি কংগ্রেসকে সমর্থন করে, তা হলে তৃণমূলকে দেওয়া দরকার।” সাইফুলের শেষ প্রস্তাবটা নিয়ে ঘোর আপত্তি কাটিং মাস্টার জাকির হোসেনের। “এ দলটা কথার বরখেলাপ করে হামেশাই। এর কোনও গ্যারান্টিও নেই, ওয়ারেন্টিও নেই,” বলেন জাকির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sahin akthar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE