ঘটনাস্থলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলছেন পুলিশ সুপার।
সকালেই এন্তার গোলাগুলি ছুটেছে। মৃত্যু হয়েছে এক মহিলার। জখম আরও দুই মহিলা ও এক কিশোর। চাপ-চাপ রক্তে জমাট বেধেছে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামে শোকের আবহ।
গ্রামের মালিকানাহীন ২২ বিঘা জমির দখল নিয়ে গোলমাল। দীর্ঘ ৩০ বছর ওই জমিতে চাষবাস করে আসা (পাট্টা নেই যদিও) ৫৬টি পরিবারকে দখল ছাড়ার জন্য গত কয়েকমাস ধরেই হুমকি দিচ্ছিল গ্রামের কিছু সমাজবিরোধী। ভয় থাকলেও পরিবারের একমাত্র উপার্জনের উপায় চাষবাসের ওই জমি ছাড়তে পারেনি দীনদুঃখী পরিবারগুলি। বাস্তবিকই গুলি বোমা হাতে দুষ্কৃতীরা হামলা চালাবে, এতটা ভাবতেও পারেনি তারা।
দুষ্কৃতী বলতে গ্রামের লোকজন মূলত একটাই নাম বলছেন তিনি হলেন লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা। এফআইআর-এও তাঁর নাম রয়েছে। বিজেপি-র নদিয়া জেলার মুখপাত্র সৈকত সরকার বলেন, “লঙ্কার লক্ষ্যই ছিল এই ধরনের আইনি জটিলতা যুক্ত জমি। স্থানীয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক শ্রেণির কর্মীর সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল। ওঁরা লঙ্কা ঘোষকে ওই ধরনের জমির হদিস দিতেন। তারপর লঙ্কা ভয় দেখিয়ে, গায়ের জোরে কিংবা মিথ্যা কাগজপত্র করে ওই সব জমি চড়া দামে কেনাবেচা করত। একাজে ওঁকে তৃণমূলের পঞ্চায়েত থেকে সর্বস্তরের নেতারা এবং পুলিশ সমর্থন করত।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত ছ’মাস ধরে লঙ্কার দলবলের অত্যাচার বাড়ছিল। ওই জমিতে চাষ করা দেবানন্দবাবু, স্বপনবাবুরা লঙ্কার নাম করেই বলেন, “ইদানীং পীরপুরের বাজারে সব্জি বিক্রি করতে গেলে মারধর করত ওর লোকেরা। মাল বিক্রি করতে দিত না। বলত ওই জমি নাকি কিনে নিয়েছে। না উঠলে খুন করে ফেলবে। এজন্য মাস দু’য়েক আগে আমরা সবাই মিলে বসে মিটিং করে স্থানীয় থানা, বিএলএলআরও দফতর এবং জেলা সদরে সব জানিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। তা হলে আজ এই ঘটনা ঘটত না।”
রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় যখন গ্রামে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা, তখন পুরুষরা প্রায় ছিলেন না বললেই চলে। মূলত মহিলা ও বাড়ির ছেলেমেয়েরাই কাজ করছিলেন জমিতে। জমিতে ফলানো কষ্টের ফসল দুষ্কৃতীরা ট্রাক্টর দিয়ে মাড়াচ্ছে দেখে চুপ থাকতে পারেননি তাঁরা। প্রতিরোধ করতে দিয়েই বোমা-গুলির বর্ষণের মুখে পড়তে হয়। বেঘোরে প্রাণ হারান অপর্ণা বাগ (৩৮)। গুরুতর জখম হয়েছেন শ্যামলী তরফদার নামে বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা। তাঁর গালের কাছে গুলি লেগেছে। এ দিন দুপুরে শ্যামলীদেবীকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করালে প্রাথমিক চিকিত্সার পর কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
বোমা-গুলির মাঝে পড়ে গুলি লেগেছে বছর সতেরোর রাজীব মণ্ডলের ডান পায়ে। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন সে। এ দিন বাড়ির অদূরে একশো দিনের কাজে মাটি কাটছিল বলে জানায় স্থানীয় স্বর্ণখালি হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাজীব। আচমকা গুলির শব্দ শুনে কাজ ফেলে পালাতে যায় সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান পায়ে গোড়ালির কাছে গুলি লাগে। রাজীবের বাবা রাজকুমার মণ্ডল জেলা হাসপাতালের অস্ত্রোপচার বিভাগে ছেলের বিছানার পাশে বসে বললেন, ‘‘আমি প্রান্তিক চাষি। ওই জমির মধ্যে সাত কাঠা পেয়েছিলাম। সেই জমিতে চাষ করতাম। কয়েক কাঠা জমির জন্য ছেলেটাকে এ ভাবে বিপদে পড়তে হবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। সামনে পরীক্ষা ওর। কী যে হবে জানি না।” হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন বিকেল নাগাদ অস্ত্রোপচার করে রাজীবের পা থেকে গুলি বার করা হয়। তারপর ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে পায়ে। সন্ধ্যার দিকে রাজীব অবশ্য অনেকটাই সুস্থ বলে দাবি চিকিত্সকদের। বিছানায় কম্বল চাপিয়ে শুয়ে শুয়ে রাজীব ধীরে ধীরে কথাও বলতে পারছে।
জখম লতিকা তরফদারও শক্তিনগরে চিকিত্সাধীন। তাঁর কানের কাছে গুলি লেগেছে। কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, ওই গুলি ভেতরে নেই। লতিকা তরফদারের মা মিনতি বিশ্বাস জানান, গ্রামেই বছর কুড়ি আগে বিয়ে হয়েছিল মেয়ের। তাঁর দুই ছেলে রয়েছে। বছর তিনেক আগে পথ দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গিয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন লতিকাদেবী। সাত কাঠা ছিল তাঁর ভাগে। মিনতি বিশ্বাসের কথায়, ‘‘বুঝতে পারিনি মেয়েকে গুলি খেতে হবে। আগেভাগে বিপদের আঁচ পেলে মেয়েকে ওই তল্লাটেই ঘেঁষতে দিতাম না।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy