Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পথের টক্করেই চাঙ্গা বামেরা

মমতার চ্যালেঞ্জ শুনেই পাল্টা গর্জন সূর্যকান্তর

প্রথমে নবান্ন অভিযান। তার পরে সাধারণ ধর্মঘট। এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর দুই কর্মসূচিকে হাতিয়ার করে পথে নেমে শাসক দল ও প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর নিল বামেরা। এবং এই দুই ঘটনার সূত্রেই রাজ্য রাজনীতিতে আবার প্রধান বিরোধী পক্ষের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করল তারা। লোকসভা ভোটের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যে তকমা কার্যত চলে গিয়েছিল বিজেপির দখলে।

সরকারি নির্দেশ মানার খেসারত তিনি দিলেন ইট ও বাঁশের আঘাতে মাথা ফাটিয়ে। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সরকারি নির্দেশ মানার খেসারত তিনি দিলেন ইট ও বাঁশের আঘাতে মাথা ফাটিয়ে। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

প্রথমে নবান্ন অভিযান। তার পরে সাধারণ ধর্মঘট। এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর দুই কর্মসূচিকে হাতিয়ার করে পথে নেমে শাসক দল ও প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর নিল বামেরা। এবং এই দুই ঘটনার সূত্রেই রাজ্য রাজনীতিতে আবার প্রধান বিরোধী পক্ষের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করল তারা। লোকসভা ভোটের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যে তকমা কার্যত চলে গিয়েছিল বিজেপির দখলে।

কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ১৭ দফা দাবিতে বুধবার দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রে়ড ইউনিয়ন। যার মধ্যে বামেদের একাধিক সংগঠনের পাশাপাশি কংগ্রেস প্রভাবিত আইএনটিইউসি-ও ছিল। কিন্তু এ রাজ্যে ধর্মঘটের পুরো ভাগে দেখা গিয়েছে বামেদেরই। বাম নেতা-কর্মীরাই সক্রিয় ভাবে পথে নেমেছিলেন। যার জন্য দিনের শেষে ধর্মঘটের নামে ‘গুন্ডামি’র দায় বামেদের ঘাড়েই চাপিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দিল্লিতে সিপিএম শূন্য হয়ে গিয়েছে। এখানেও কিছু নেই। যেটুকু আছে, ক’দিন পরে সেটাও শূন্য হয়ে যাবে!’’

বিধানসভা ভোটের ক’মাস আগে জড়তা কাটিয়ে ওঠা সিপিএম পত্রপাঠ সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী ওই ঘোষণা করে ওঠা মাত্রই আলিমুদ্দিনে বসে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ করেছেন, আমরা তা গ্রহণ করলাম। এর পরে রাস্তায় আরও বড় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ওঁকে দেখতে হবে। চ্যালেঞ্জ করছি, লড়াইয়ের ময়দানে আবার দেখা হবে!’’ বিদ্যুৎ মাসুল বৃদ্ধি, টেট কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ, খাদ্য সুরক্ষার জন্য আবেদনের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি, ইত্যাদি নানা কর্মসূচিতে তাঁরা সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখবেন বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।

বস্তুত, ধর্মঘটের দিনে রাজ্যের প্রায় সর্বত্র বামেদের পথে নামা এবং সিপিএমের পাল্টা চ্যালেঞ্জ ভাবিয়ে তুলেছে শাসক দলকে। তাই মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার বাগ্‌যুদ্ধের পরে তৃণমূল ভবনে আবার তড়িঘড়ি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। দলনেত্রীর কথারই প্রতিধ্বনি করে তিনি জানিয়েছেন, ধর্মঘটের নামে বামেদের ‘তাণ্ডবে’র প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতি ও কাল, শুক্রবার বিকাল ৪টে থেকে এক ঘণ্টা করে ‘ধিক্কার দিবস’ পালন করা হবে। পার্থবাবু এই ঘোষণা
করার আগেই অবশ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়ে দিয়েছেন, ধর্মঘট ভাঙার নামে শাসক দল ও পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজ ১৭টি বাম দল রাজ্য জুড়ে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করবে। যার অর্থ আজ আবার রাস্তায় পরস্পরের বিরুদ্ধে সেই বাম ও তৃণমূল!

প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য রাজনীতির সমীকরণের চাকা আবার কী ভাবে ঘুরে গেল? বাম শিবিরের দাবি, রাস্তায় নেমে আন্দোলনের চেনা কৌশলে ফিরে গিয়েই প্রবল ভাবে ফিরে আসতে পেরেছে তারা। গত চার বছরে মমতার সরকারের নানা কাজকর্মে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হলেও বামেদের কেন সে ভাবে পথে দেখা যাচ্ছে না, এই প্রশ্ন বারবার উঠেছে। সূর্যবাবুরা বারবারই বলে এসেছেন, নতুন সরকারকে তাঁরা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। নিজেদের সংগঠন গুছিয়ে নেওয়ার তাগিদও ছিল। এখন বিধানসভা ভোটের মুখে তাঁরা সেই স্ব-আরোপিত লক্ষ্মণরেখা পেরোতে চাইছেন। জনমানসে বাম নেতারা বার্তা দিতে চাইছেন, তাঁরা লড়াইয়ে আছেন। যে কারণে মমতার জমানায় প্রথম ধর্মঘটের সমর্থনে বুধবার সকাল থেকেই রাস্তায় দেখা গিয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক থেকে বামফ্রন্টের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের। বামেরা যত পথে নেমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে, ততই তাদের উপরে শাসক দলের হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। বহরমপুরে প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, মহম্মদবাজারে বিধায়ক ধীরেন বাগদি, হরিহরপাড়ায় বিধায়ক ইনসার আলির মতো অনেক বাম নেতা-কর্মীই ভাল রকম জখম হয়েছেন। আক্রমণ হচ্ছে মানে শাসক দল ভয় পেয়েছে, এই বার্তা নিয়ে আরও তৎপরতার সঙ্গে নেমে পড়েছেন সূর্যবাবু-বিমানবাবুরা। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে আজই বহরমপুর ও মহম্মদবাজার যাচ্ছেন সূর্যবাবু।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

বাম নেতৃত্বের দাবি, প্রবল আক্রমণ সত্ত্বেও ধর্মঘট ‘সফল’। শাস্তির ভয়ে সরকারি দফতর ছাড়া আর কোথাওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। ট্রেন এবং সরকারি পরিবহণ চলেছে। বেসরকারি পরিবহণ কম। যাত্রী আরও কম! চা-বাগান থেকে চটকল, শিল্পের ঝাঁপ প্রায় বন্ধ। যদিও ঘটনা হল, যে কেউ ধর্মঘট ডাকলেই ঘরবন্দি থাকা এ রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষের মজ্জাগত অভ্যাসতাতে বামেদের বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করার কিছু নেই! মূল্যবৃদ্ধি বা পেনশন-পিএফের টাকা শেয়ারে খাটনোর প্রতিবাদে এ বারের ধর্মঘটের কিছু দাবির সঙ্গে আম জনতার একাংশের সহমর্মিতা ছিল ঠিকই। কিন্তু সাধারণ ভাবেই আম বাঙালির কিছু অংশ যেমন ছুটির মেজাজে ধর্মঘট কাটান, তেমনই আর এক অংশ আবার গোলমালের ভয়ে রাস্তায় বেরোন না। নবান্ন অভিযানে বাম-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধের পরে এ বারের ধর্মঘট নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল সমূহ।

এবং এই সূত্রেই মমতার ভূমিকাকে ধর্মঘট ‘সফল’ হওয়ার পিছনে পরোক্ষ কারণ হিসাবে মেনে নিচ্ছে আলিমুদ্দিনের একাংশই! সিটুর রাজ্য সম্পাদক দীপক দাশগুপ্ত যেমন ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিয়েছেন, ‘‘শেষ দিকে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে হিংস্র ভঙ্গিতে হুমকি দিতে শুরু করেছিলেন, সেটাই আমাদের কাজ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে!’’ বাম নেতাদের একাংশই বলছেন, ধর্মঘট ঠেকাতে মরিয়া হয়ে একের পর এক সরকারি নির্দেশ জারি করে মুখ্যমন্ত্রীই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এই ধর্মঘট যেন জীবন-মরণের প্রশ্ন! তাতে সাধারণ মানুষের একাংশ যেমন সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন, তেমনই ধর্মঘটীদের জেদ বেড়ে গিয়েছে।

এর সঙ্গেই দ্বিতীয় কারণ হিসাবে উঠে আসছে বিজেপি-তৃণমূলের নৈকট্যের বাতাবরণ। সাধারণ ধর্মঘট ছিল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। অথচ তা ব্যর্থ করতে তৃণমূলের সরকার কেন এত সক্রিয়, এই প্রচার গত তিন দিনে প্রবল ভাবে তুলে এনেছিল বামেরা। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, ‘‘মোদীর জন্য মাঠে নেমেছেন দিদি। নেমে ফাউলও করছেন! এর পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যা বোঝার, বুঝে নেবেন!’’ ধর্মঘটী শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রশ্ন তুলেছে, বিজেপি-শাসিত নানা রাজ্যেও ধর্মঘট হয়েছে। কোথাও সংঘর্ষ, রক্তপাত হয়নি। তা হলে এ রাজ্যেই পুলিশ এবং শাসক দলকে ধর্মঘট ভাঙতে নামানো হল কেন?

তৃণমূল-বিজেপি নৈকট্যের জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে কিছু ঘটনাপ্রবাহে। স্বচ্ছ বিদ্যালয় পরিকল্পনার আওতায় স্কুলে শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ১০০%-রও বেশি সাফল্য পেয়েছে বলে মঙ্গলবার টুইট করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই তথ্যই রিটুইট করে সাফল্যের দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন কলকাতায় দাবি করেছেন, বামেদের ধর্মঘটকে মোটেই সফল বলা চলে না। তাঁর অভিযোগ, ‘‘রাজ্য সরকার চাইলে ধর্মঘট রুখতে পারত। কিন্তু পুলিশ সক্রিয় হয়নি! সিপিএম-তৃণমূল গোপন বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে।’’ কিন্তু বামেদের প্রশ্ন, বিজেপি আগ বাড়িয়ে তৃণমূলের সুরে ধর্মঘটকে ব্যর্থ বলতে গেল কেন? ধর্মঘট আসলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই ডাকা হয়েছিল, বিজেপি শিবির এই যুক্তি দেখালেও বামেদের দাবি, তলায় তলায় বিজেপি-তৃণমূলে ‘‘সেটিং হয়ে গিয়েছে!’’

এখন প্রশ্ন হল, তৃণমূল-বিজেপি’কে এক বন্ধনীতে রেখে বিধানসভা ভোটের আগে এ বার কি তা হলে ‘সেটিং’ সেরে নেবে বাম-কংগ্রেস? ধর্মঘটে সমর্থন জানালেও প্রদেশ কংগ্রেসকে এ দিন অবশ্য বামেদের মতো রাস্তায় দেখা যায়নি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ধর্মঘটে আইএনটিইউসি ছিল। কংগ্রেসের নৈতিক সমর্থন থাকলেও সক্রিয় ভাবে তাদের রাস্তায় নামার কথা ছিল না। তবে বামেদের পাশে দাঁড়িয়েই অধীরের অভিযোগ, তৃণমূল আশপাশের গ্রাম এমনকী জেলার অন্যান্য প্রান্ত থেকেও বহিরাগতদের এনে বহরমপুরে বামেদের ধর্মঘটে বাধা দিয়েছে।

বাম-কংগ্রেস সুর মিলে যাওয়ার এই আবহেই পরবর্তী প্রশ্ন, ধর্মঘট কি বামেদের চাঙ্গা করে গেল? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবুর জবাব, ‘‘বামেরা চাঙ্গা কি না, সে তো ফলেন পরিচীয়তে! তবে মানুষ ধীরে ধীরে বুঝে নিচ্ছেন, কে কী করছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE