Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ব্যতিক্রম ছিল, যুক্তি বুদ্ধদেবের

নির্বাচনে উল্টো ফল বাস্তবকে উল্টে দিতে পারে না, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাড়ে তিন বছর পরেও এমন বিশ্বাসেই প্রত্যয়ী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জমি অধিগ্রহণের ফলে তাঁর সরকার উল্টে গিয়েছে। দল জমি হারিয়েছে। প্রবল বিতর্ক হয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে। জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বামফ্রন্টের রাজ্যপাট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

নির্বাচনে উল্টো ফল বাস্তবকে উল্টে দিতে পারে না, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাড়ে তিন বছর পরেও এমন বিশ্বাসেই প্রত্যয়ী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

জমি অধিগ্রহণের ফলে তাঁর সরকার উল্টে গিয়েছে। দল জমি হারিয়েছে। প্রবল বিতর্ক হয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে। জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বামফ্রন্টের রাজ্যপাট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পরেও সিপিএমের অন্দরে দলিল পেশ করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু জানিয়ে দিলেন, শিল্পায়নের পথে এগোনোর জন্য তাঁর সরকারের নীতি ঠিক ছিল। শিল্পের জন্য জমি নেওয়াও ছিল প্রখর বাস্তবতা। এই অনিবার্য প্রক্রিয়ার মাঝে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ছিল ‘ব্যতিক্রম’। দুই ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল। যার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে সফল হয়েছিল বিরোধীদের ‘রামধনু জোট’। ব্যতিক্রম থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু ব্যতিক্রমের জন্য শিল্পায়নের পথ থেকে সরা যায় না বলেই তাঁর সাফ যুক্তি।

জমি নীতি নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আজ, বুধবার থেকে রাজ্যে শুরু হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন। শিল্পের জন্য কোনও ভাবেই সরকার জমি নিতে যাবে না এই নীতি আঁকড়ে থাকলে ঘটা করে সম্মেলন করেও শিল্প আসবে কী ভাবে, অবিরত সেই প্রশ্ন তুলে চলেছে শিল্প ও বণিক মহল। সেই সময়েই বুদ্ধবাবুর হাতে তৈরি ওই দলিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

আগামী মার্চে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে বিতর্কের পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই দলিলে সিলমোহর পড়ার কথা। সে ক্ষেত্রে এই দলিলে স্পষ্ট বার্তা থাকছে ভবিষ্যতে সরকারে ফিরলে শিল্পায়নের নীতি থেকে সরবেন না বুদ্ধবাবুরা। তবে জমি নেওয়া হবে সতর্কতার সঙ্গে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ‘ব্যতিক্রম’ এড়িয়ে।

রাজ্যে তাঁদের ৩৪ বছর সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। সেই জন্যই ঠিক হয়েছিল, বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের কাজের মূল্যায়নের জন্য দল একটি বিশেষ দলিল তৈরি করবে। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের অসুস্থতার জন্য সেই কাজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন আর এক পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু। আলিমুদ্দিনে সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে মঙ্গলবার সেই খসড়া রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। সরকার চালাতে গিয়ে আরও কিছু বিষয়ে নজর রাখলে ভাল হতো, এই ধরনের কিছু মত ছাড়া শিল্পায়নের নীতি নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিরাট কোনও বিরোধিতা আসেনি রাজ্য কমিটিতে।

বুদ্ধবাবুর তৈরি ৩৫ পাতার ওই দলিলে ‘জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে’ এবং ‘সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে ব্যতিক্রম’ শীর্ষক দু’টি অধ্যায় রাখা হয়েছে। প্রথমটিতে পরিষ্কারই বলা হয়েছে: ‘নতুন শিল্পের জন্য জমি প্রয়োজন। আমাদের রাজ্যে অকৃষি খালি জমি পাওয়া দুষ্কর। পরিকল্পনা করে এই জমিগুলি নির্দিষ্ট করতে হয়’। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, এ রাজ্যে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ ১ কোটি ৩৫ লক্ষ একর। বাম আমলে শুধু প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনাতেই সাড়ে ৯ হাজার কিলোমিটার রাস্তা হয়েছে জমি নিয়ে। এই অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সরকারি পরিকল্পনা যতই বাস্তবসম্মত হোক, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেই পরিকাঠামো ও শিল্পের জমি ব্যবহারে দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে’।

নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার জন্য বহু আগেই ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন বুদ্ধবাবু। এ বারের রিপোর্টে আর সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়নি। বরং দেখানো হয়েছে, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম এক ছিল না। সিঙ্গুরে ৮২.৮২% জমি দিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ। তার পরে নন্দীগ্রামের ঘটনাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে মানুষকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। আর স্থানীয় মানুষের আপত্তিতে নন্দীগ্রামের প্রকল্প নিয়ে প্রথমেই ঠিক হয়েছিল, আর এগোনো হবে না। রিপোর্টের ভাষায়, ‘তবু স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের অপ্রয়োজনীয় তৎপরতার ফলে মানুষের মনোভাব আমাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে’। অর্থাৎ ইঙ্গিত অধুনা বহিষ্কৃত লক্ষ্মণ শেঠদের কর্মকাণ্ডের দিকে!

দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “জমি অধিগ্রহণের বিরাট মাসুল আমাদের দিতে হয়েছে ঠিকই। প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ভুল হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের স্বার্থে শিল্পায়নের নীতি যে ভুল ছিল না, এক দিন মানুষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sandipan chakrabarty buddhadeb bhattacharyay cpm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE