Advertisement
০৪ মে ২০২৪
তদন্তকারী ব্যস্ত অন্যত্র, এল না কেস ডায়েরিও

একের পর এক আর্জি খারিজের পর হঠাৎ জামিন মদনের

এক-দুই-তিন-চার….কতগুলো আবেদন যে খারিজ হয়ে গিয়েছে, সঠিক ভাবে সংখ্যাটা মনে করতে পারেন না অনেকেই! এ দিনেরটাও সেই তালিকাতেই ঢুকে যাবে এমনটাই মনে করছিলেন অনেকে। কিন্তু আচমকাই বদলে গেল ছবিটা!

অবশেষে স্বস্তি। শনিবার এসএসকেএম হাসপাতালে তোলা নিজস্ব চিত্র।

অবশেষে স্বস্তি। শনিবার এসএসকেএম হাসপাতালে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস ঘটক ও সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

এক-দুই-তিন-চার….কতগুলো আবেদন যে খারিজ হয়ে গিয়েছে, সঠিক ভাবে সংখ্যাটা মনে করতে পারেন না অনেকেই! এ দিনেরটাও সেই তালিকাতেই ঢুকে যাবে এমনটাই মনে করছিলেন অনেকে। কিন্তু আচমকাই বদলে গেল ছবিটা!

আদালতে পুজোর ছুটি চলছে। এমন একটা সময়ে আলিপুর জেলা ও দায়রা আদালতের অবকাশকালীন আদালতে হঠাৎই জামিন পেয়ে গেলেন সারদা মামলায় প্রায় এক বছর ধরে জেলবন্দি রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী মদন মিত্র। যে খবরে হতবাক মদন-ঘনিষ্ঠেরাও। মন্ত্রী এ দিন জামিন পেতে পারেন, এমন কোনও আশা তাঁদের বড় অংশই করেননি। তাঁদের কাছে মদনের জামিনের খবরটা যেন ‘মেঘ না চাইতেই জল’!

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ জানা গেল, সারদা মামলায় দশ মাসের বেশি বন্দি থাকার পর মদন মিত্র জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। আলিপুর জেলা ও দায়রা আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক পার্থপ্রতিম দাস এ দিন ২ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত রাজ্যের এই মন্ত্রীর জামিন মঞ্জুর করেন। সারদা-কাণ্ডে আর এক অভিযুক্ত সন্ধির অগ্রবালকেও এ দিন জামিন দেন বিচারক।

এ দিন মদনের জামিনের পর শুধু যে রাজনৈতিক শিবির থেকে গুঞ্জন শোনা গিয়েছে, তা নয়। আইনজীবী মহল থেকেও উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন। হাইকোর্টে একাধিক বার মদনবাবুর জামিনের আবেদন খারিজ হওয়ার পর কী ভাবে ফের নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন করলেন তাঁর আইনজীবীরা, সে প্রশ্ন উঠেছে। তা-ও আবার এমন একটা সময়ে, যখন আদালতের ছুটি চলছে। আইনজীবীদের একাংশের দাবি, এই সময়ে সাধারণত কোনও জামিন হয় না। মামুলি চুরির আসামিরও না! অথচ সারদার মতো আলোড়ন ফেলে দেওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রাজ্যের মন্ত্রী জামিন পেয়ে গেলেন! এবং এমন দিনে, যে দিন কেস ডায়েরি পেশ করা হয়নি। উপস্থিত নেই তদন্তকারী অফিসারও। আলিপুর আদালতের এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘এই বিচারকের এজলাসেই মাসখানেক আগে সারদা-কাণ্ডে ধৃত শিবনারায়ণ দাস নামে এক অভিযুক্তের জামিন হয়ে গিয়েছিল। তার পরই এই বিচারকের এজলাসে মদন মিত্র ও সন্ধির অগ্রবালের জামিনের আবেদন করা হয়। তাও আবার অবকাশকালীন আদালতে! এবং দু’জনে জামিনও পেয়ে গেলেন!’’


হাসপাতালে নাতিকে নিয়ে হাজির বৌমা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সিবিআই অবশ্য বসে থাকছে না। এই জামিনের নির্দেশের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে যাচ্ছে তদন্তকারী সংস্থাটি। আগামিকাল, সোমবার হাইকোর্টে আবেদন করার কথা সিবিআইয়ের।

জুলাই মাসে দুঁদে আইনজীবী কপিল সিব্বল যখন দিল্লি থেকে উজিয়ে এসে মদনবাবুর হয়ে জামিনের সওয়াল করেছিলেন, সে দিন ছিল টানটান উত্তেজনা। মদনের মিত্র ও শত্রু— দু’পক্ষই সেই আঁচে ফুটছিলেন। সে দিন মদন জামিনে মুক্তি পাননি। সমর্থকদের আশায় জল পড়ে গিয়েছিল। অথচ আপাত ম্যাড়ম্যাড়ে একটা দিন বলে যাকে মনে করেছিলেন সমর্থকেরা, সেই দিনটাই হঠাৎ করে উৎসবমুখর হয়ে গেল!

এ দিন মদনের জামিনের পরে প্রশ্ন উঠেছে সিবিআইয়ের কৌঁসুলি কে রাঘবচারিলুকে নিয়ে। যে দুঁদে কৌঁসুলি গত জুলাইয়েই কলকাতা হাইকোর্টে একের পর এক আইনি চালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বলকে পর্যুদস্ত করে মদন মিত্রের জামিন রুখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এ দিনের রাঘবচারিলুর মিল তেমন পাওয়া গেল না বলে জানিয়েছেন আদালতে হাজির অনেক আইনজীবীই। শুধু তা-ই নয়। এ দিন প্রথম পর্যায়ের শুনানিতে অংশ নিলেও দ্বিতীয় পর্যায়ের শুনানিতে হাজিরই থাকেননি রাঘবচারিলু! এমনকী শুনানির অন্য দিন ধার্য করার আবেদনপত্রে নিজে সইও করেনি!

এ দিন এজলাসে বিচারকের কাছে রাঘবচারিলু নিজের পরিচয় দিয়ে জানান, তদন্তকারী অফিসার রায়পুরে অন্য একটি মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়েছেন। মামলার কেস ডায়েরিও এ দিন করা যাবে না। ফলে ফের শুনানির জন্য নতুন দিন ধার্য করা হোক। এই রাঘবচারিলু যে তাঁদের কাছে অনেকটাই অচেনা, সেটা মদন মিত্রের আইনজীবীদের কয়েক জনও জানিয়েছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘বেহালা কেমন যেন আজ বেসুরে বাজল!’’

রাঘবচারিলুর বক্তব্য শোনার পরেই মদনের পক্ষে আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায়, বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, নীলাদ্রি ভট্টাচার্যেরা জানান, এই শুনানির দিন আগেই ধার্য করা হয়েছিল। তা হলে তদন্তকারী অফিসার হাজির হলেন না কেন? কেনই বা কেস ডায়েরি হাজির করা হল না? দু’পক্ষের সওয়াল শোনার পরে বিচারক জানান, এ দিনই মামলা শুনবেন তিনি। কেস ডায়েরি নিয়ে আসার জন্য সময়ও দেন। বেলা ৩টে ২০ মিনিটে ফের মামলা শুরু হয়।

ফের শুরু হয় নাটক। দেখা যায়, রাঘবচারিলু আর হাজির হননি! বদলে হাজির হয়েছেন আর এক আইনজীবী অঙ্কুশ সরকার। রয়েছেন আইনজীবী পার্থসারথি দত্তও।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

কেস ডায়েরির বদলে অঙ্কুশবাবু একটি আর্জিপত্র বিচারককে দেন। তিনি বলেন, সিবিআইয়ের কৌঁসুলি কে রাঘবচারিলু এটি পাঠিয়েছেন। সেটি পড়ার পরেই বিচারকের মুখের ভঙ্গি পাল্টে যায়। বিচারক জানান, সিবিআইয়ের কৌঁসুলি ওই চিঠিতে লিখেছেন, কেস ডায়েরি এ দিন হাজির করা যাবে না। পাশাপাশি এই জামিনের আর্জিটি নিয়ে আদালত অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে বলেও ওই চিঠিতে লেখা হয়েছে। বিষয়টি আদালত আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন বলেও সিবিআইয়ের কৌঁসুলি লিখেছেন। এই ধরনের মন্তব্য বিচারক ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অসম্মানজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিচারক।

এর পরেই বিচারক বলেন, মদন মিত্র দীর্ঘদিন ধরেই জেলে বন্দি। তিনি জামিন পেলে তদন্তকে প্রভাবিত করবেন, এমনও কোনও কারণ দেখাতে পারেনি সিবিআই। তার পরেই তিনি জামিনের নির্দেশ দেন।

এ দিনের ঘটনায় সিবিআইয়ের অফিসারদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সপ্তাহখানেক আগে নোটিস জারি হওয়ার পরেও কেস ডায়েরি কেন পেশ করা হল না? কেন তদন্তকারী অফিসার উপস্থিত থাকলেন না?

রাঘবচারিলুর দাবি, ‘‘গত ১৪ অক্টোবর মদন মিত্রের জামিনের আবেদন যে হয়েছে, সেই ব্যাপারে আদালত থেকে আমাদের কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। মদন মিত্রের আইনজীবীর পক্ষ থেকে শুধু একটি নোটিস দেওয়া যে, শনিবার শুনানি হবে। আমাদের কাছে যার অর্থ, এ দিন আদালতে আমরা হাজির হলে জামিনের আবেদনের জন্য আর একটি দিন স্থির করা হবে। যে হেতু আমরা আদালতের নোটিস পাইনি, তাই জামিনের আবেদনের শুনানি এ দিন হওয়ার কথাই নয়।’’

বিচারকের কাছে পেশ করা আর্জিপত্রে রাঘবচারিলুর কিছু মন্তব্য নিয়েও এ দিন প্রশ্ন উঠেছে। যদিও সিবিআইয়ের একটি সূত্রের দাবি, রাঘবচারিলু সরকারি কৌঁসুলি। বিচারকের ভূমিকা নিয়ে সরকারি কৌঁসুলিদের যদি কোনও সংশয় দেখা দেয়, তা হলে তা স্পষ্ট ভাবে জানানো অধিকার রয়েছে তাঁদের।

মদনবাবুর জামিনের কাগজ শনিবার সন্ধ্যায় জেলে পৌঁছে গিয়েছে। তবে তিনি এখন এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। মদন-ঘনিষ্ঠদের খবর, এখনই তিনি হাসপাতাল থেকে যেতে চাইছেন না। কয়েক দিন অপেক্ষা করতে চান। তার মধ্যে সিবিআই হাইকোর্টে যাক। যাতে কেউ বলতে না পারে, জামিনে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মদন হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে গেলেন। সুতরাং, তাঁর অসুস্থতাটা আসলে লোকদেখানো!

সারদা-তদন্তে সিবিআই তদন্তের আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়োদৌড়ি করা কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান এ দিন বলেন, ‘‘মমতা ও মোদীর যে গোপন আতাঁত হয়েছে, তা মদন মিত্রের জামিনের ঘটনায় আরও এক বার প্রমাণিত হল। সিবিআই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীনে রয়েছে। তারা ক’মাস ধরেই তদন্তে ঢিলে দিচ্ছিল। এখন আইনি ফাঁকফোকর তৈরি করে অভিযুক্তদের জামিনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে!’’

সারদা মামলার অন্যতম আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিচারক কী ভাবে কেস ডায়েরি ছাড়া জামিন মঞ্জুর করলেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কী এমন নতুন তথ্য পেলেন, যার ভিত্তিতে জামিন মঞ্জুর করলেন। এটা পদ্ধতিগত ত্রুটি। সিবিআইয়ের হাইকোর্টে যাওয়া উচিত।’’

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘আমি শুনেছি, সপ্তাহখানেক আগেই সিবিআইকে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেন সিবিআই কেস ডায়েরি দাখিল করতে পারল না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তদন্তকারী অফিসার না-ও হাজির থাকতে পারেন। কিন্তু আইনজীবীরা কেস ডায়েরি পেশ করতে পারতেন।’’

জামিনে মুক্তি পেলেও মদনের পাসপোর্ট তদন্তকারীদের কাছে জমা রাখতে হবে। তদন্তের স্বার্থে সিবিআই যখনই ডাকবে তখনই মন্ত্রীকে হাজিরা দিতে হবে। এ দিন জামিনের নির্দেশ শোনার পর মদন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ‘‘সত্যের জয় হল।’’

সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর থেকেই মদনের বিরুদ্ধে ওই সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ ওঠে, সারদা কর্মী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পদেও ছিলেন মদনবাবু। সংগঠনের সভায় তাঁর হাজির থাকার প্রমাণও রয়েছে বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা। সারদা তদন্ত চলাকালীন গত ১২ ডিসেম্বর মদনকে তলব করে সিবিআই। সে দিনই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। সিবিআই হেফাজত থেকে জেলে গিয়েছিলেন মদনবাবু। তার পর অসুস্থতার জন্য তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। খাতায়-কলমে জেল হেফাজতে থাকলেও এসএসকেএম হাসপাতালেই এত দিন কাটিয়েছেন মদন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE