Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
তদন্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

আরাবুল ফিরলেন, ভয়ে চুপ দুই পরিবার

চুপ দুই পরিবারই। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হাত তুলে তাঁরা ‘উপরওয়ালা’কে দেখাচ্ছেন। কিন্তু মুখে কথা নেই। অনেক অনুরোধের পরে হাতজোড় করে তাঁদের কাতর আবেদন— ‘সবাই যেন পাশে থাকে। একটু দেখবেন।’

বেঁওতায় নিহত রমেশ ঘোষালের বৃদ্ধা মা। ছবি: সামসুল হুদা।

বেঁওতায় নিহত রমেশ ঘোষালের বৃদ্ধা মা। ছবি: সামসুল হুদা।

শুভাশিস ঘটক
ভাঙড় শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫১
Share: Save:

চুপ দুই পরিবারই।

চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হাত তুলে তাঁরা ‘উপরওয়ালা’কে দেখাচ্ছেন। কিন্তু মুখে কথা নেই। অনেক অনুরোধের পরে হাতজোড় করে তাঁদের কাতর আবেদন— ‘সবাই যেন পাশে থাকে। একটু দেখবেন।’

১৪ মাস আগে নিহত ভাঙড়ের তৃণমূল কর্মী— রমেশ ঘোষাল এবং বাপন মণ্ডলের পরিবারের লোকজন। দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে যে জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল ভাঙড়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে। এত দিনে আরাবুলের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দল তাঁকে ওই ঘটনার পরে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করলেও বুধবারই তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে ভাঙড়ে শাসকদলের একাংশ খুশি হলেও ফের গোলমালের আশঙ্কা অন্য অংশের। তারা মনে করছে, এর পরে তদন্তের কাজে পুলিশও গা-ছাড়া মনোভাব দেখাবে। সাক্ষী পাওয়াও শক্ত হবে।

আরাবুল প্রশ্নে নীরব নিহতদের পরিবারের লোকজনও। বৃহস্পতিবার বিকেলে রমেশের মা ময়নাদেবী ছেলের খুনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। শুধু বলেন, ‘‘ভগবান বিচার করুক। আমাদের পাশে কেউ নেই। আমরাও তো তৃণমূল করতাম। ছেলেকে বাঁচাতে হামলাকারীদের পায়ে ঝাঁপিয়েও পড়েছিলাম। কিন্তু কিছুই হল না।’’ বাপনের শোকে ঘটনার তিন মাস পরে মারা যান তাঁর দাদু কিশোরীমোহনবাবু। বাপনের কাকা ভজ মণ্ডলের ক্ষোভ, ‘‘আমরা এই এলাকায় সিপিএমের মার খেয়েও তৃণমূল করেছি। কিন্তু দেখলাম আমাদের পাশে কেউ নেই। এরপর কী হবে বুঝতে পারছি না!’’ তাঁরা কী ফের গোলমালের ভয় পাচ্ছেন? নিরুত্তর দুই পরিবারের লোকই। কিন্তু চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।

২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর ভাইফোঁটার দিন ভাঙড়ের বেঁওতা-২ নম্বর পঞ্চায়েতের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা রমেশের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গুলি করে, কুপিয়ে খুন করে দুষ্কৃতীরা। একই ভাবে বাপনকে খুন করা হয় রাস্তায়। দলীয় রাজনীতিতে আরাবুল বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ওই পঞ্চায়েতের তৎকালীন প্রধান পাঁচু মণ্ডল। রমেশ ও বাপন ছিলেন তাঁর অনুগামী। তৃণমূলের এক সূত্র দাবি করেছিল, পাঁচুবাবুকে পদ থেকে সরাতে আরাবুল বাহিনী চেষ্টা করছিল। ঘটনার দিন সকালে পাঁচুবাবুর বাড়িতে হামলা হয়। তিনি পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। এর পরে তাঁকে হাতের সামনে না পেয়ে রমেশ ও বাপনকে আরাবুল বাহিনী খুন করে বলে অভিযোগ। শাসকদলের চাপে পড়ে পুলিশও আরাবুলের পক্ষ নেয় বলে অভিযোগ। পুলিশ সেই অভিযোগ মানেনি। আরাবুলও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু সে দিনের সেই হামলার চিহ্ন রয়ে গিয়েছে এখনও। রমেশকে খুনের পরে তাঁর জামা-কাপড়ের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে লুঠপাট চালানো হয়েছিল। দোকানে সেই পোড়া দাগ এখনও রয়েছে। ঘরের এক কোণে স্তূপ করে রাখা রয়েছে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র। রমেশ খুন হওয়ার পরে আতঙ্কে তাঁর স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে তালদিতে বাপেরবাড়ি চলে যান। আর ফেরেননি। ময়নাদেবীর বাকি দুই ছেলে পুরোহিতের কাজ করেন। রমেশ খুন হওয়ার পরে পুলিশ তাঁর ভাইপো শান্তনুকে গ্রেফতার করেছিল। তার জন্য তাঁর সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ যায়। ময়নাদেবী বলেন, ‘‘ব্যবসা করে রমেশই পরিবারটা টানত। এখন কোনও ভাবে দিন চালাচ্ছি।’’

বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ মিটার দূরে খুন হন বাপন। ওই সময় তিনি এলাকায় ছিলেন না দাবি বাপনের কাকা, বানতলা চর্মনগরীর কর্মী ভজবাবুর। পুলিশ ভজবাবুকেই গ্রেফতার করে। জেল থেকে বেরিয়ে আর চাকরি ফিরে পাননি ভজবাবু। এখন ওই এলাকায় একটি ইমারতি সরঞ্জামের দোকানে হাজার তিনেক টাকা বেতনের চাকরি করেন। তিনিও বলেন, ‘‘দিন আনি দিন খাই। বাপনের বাবা-মা দু’জনই অসুস্থ। খরচ চালাতে হিমসিম খাচ্ছি। ছেলেটাকে নৃশংস ভাবে মারা হয়েছিল।’’

এ দিন প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান পাঁচুবাবুও এলাকায় ছিলেন না। পাশের কড়াইডাঙায় গিয়েছিলেন আত্মীয়ের বিয়েতে। বাপনকে খুনের অভিযোগে পুলিশ তাঁকে ধরেছিল। আরাবুল দলে ফিরে আসার কথা জেনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ফের হামলার ভয় পাচ্ছি।’’ একই সঙ্গে তাঁর ক্ষোভ, ‘‘যারা খুন করল, তাঁদের কোনও পদ থেকে সরানো হয়নি। উল্টে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হল। আমার সঙ্গে তো দল কোনও যোগাযোগ রাখে না।’’

আরাবুল অবশ্য সকলকে অভয় দিয়েছেন। ‘‘কেন যে সবাই ভয় পাচ্ছে, কিছুই তো বুঝছি না। সবাই শান্তিতে থাকবে’’— বলছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE