Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভয় ভেঙেই লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে ভরল ব্রিগেড

ভুল করে রবিবারই রাজধানী এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট কেটে ফেলেছিলেন কানপুর আইআইটি-র জিওফিজিক্সের শিক্ষক শান্তনু মিশ্র। ব্রিগেডের ব্যাপারটা খেয়াল হতে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এক দিন বাদে নতুন টিকিট করিয়েছেন। সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে ইউবিএস ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়ের আবার বচ্ছরকার ছুটিতে কলকাতা ফেরাই ব্রিগেডের সমাবেশের দিনক্ষণের হিসেব কষে।

কাঁধ মিলিয়ে। রবিবার ব্রিগেডের মঞ্চে সিপিএম নেতারা। ছবি: দেবাশিস রায়

কাঁধ মিলিয়ে। রবিবার ব্রিগেডের মঞ্চে সিপিএম নেতারা। ছবি: দেবাশিস রায়

অত্রি মিত্র ও রোশনী মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

ভুল করে রবিবারই রাজধানী এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট কেটে ফেলেছিলেন কানপুর আইআইটি-র জিওফিজিক্সের শিক্ষক শান্তনু মিশ্র। ব্রিগেডের ব্যাপারটা খেয়াল হতে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এক দিন বাদে নতুন টিকিট করিয়েছেন। সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে ইউবিএস ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়ের আবার বচ্ছরকার ছুটিতে কলকাতা ফেরাই ব্রিগেডের সমাবেশের দিনক্ষণের হিসেব কষে।

বেলা ১২টায় মঞ্চের ডান দিকে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’-র স্টলের সামনে পরিকল্পনামাফিক দু’জনের দেখা হয়ে গেল। যাদবপুরের জিওলজি বিভাগের প্রাক্তনী শান্তনু আর শিবপুর বিই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র অনিন্দ্য— দু’জনেই বামেদের ব্রিগেডের ‘পুরনো পাপী’! কিন্তু ভিড়ের এই একরোখা ভাবটা খুব বেশি দেখেছেন বলে তাঁরাও মনে করতে পারলেন না। শান্তনু তা-ও মাস কয়েক বাদে বিধানসভা ভোটে কলকাতায় আসার সুযোগ পাবেন। অনিন্দ্যর বছরখানেকের মধ্যে আর দেশে ফেরা হবে কি না সন্দেহ! তবু লাখো লোকের ভিড় দেখে উচ্ছ্বসিত, একদা এসএফআই কর্মী অধুনা প্রবাসী তরুণ যেন বুক ভরে অক্সিজেন নিচ্ছিলেন! বলে উঠলেন, ‘‘ক্ষমতায় থাকার সময়কার ভিড়ের সঙ্গে এই জনতার কিন্তু অনেক ফারাক। মনে রাখতে হবে, এই মানুষগুলো কিছু পাবার আশায় মাঠ ভরাননি।’’ এই জমায়েতের চোয়াল শক্ত করা ভাবটা দেখে দুই বন্ধু যেন নিজের জীবনের প্রেরণা নিয়ে গেলেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী, এখন জাপানে ‘জেএসপিএস ফেলো’ সুজয় ঘোষ বা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত তুহিন সেনও তখন ওই ভিড়ে মিশে।

বাস্তবিকই, কাছের-দূরের গ্রাম-মফস্‌সল থেকে সচরাচর যে জনতা ব্রিগেডে রাজনৈতিক দলের সমাবেশ উপলক্ষে কলকাতামুখী হয়, তার সঙ্গে শীত-পার্বনের কলকাতার এই অন্য রকম আগন্তুকদের তফাত চোখে পড়ার মতোই। কোনও মতে মাঠে বুড়ি ছুঁয়ে চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘরে ভিড় করা জনতার পাল্লা মোটেও ভারী ছিল না ওই দলে। ব্রিগেডে আসা ইস্তক অনেকেই যেন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। মঞ্চে চিত্রতারকাদের ছড়াছড়ি বা বড়সড় চমক নেই! তবু ঠাসা ভিড়টা হাঁ করে মঞ্চের দিকেই তাকিয়ে থাকল। রাজ্যে শাসক পরিবর্তনের পরে গত কয়েকটি ব্রিগেড সমাবেশে যাঁরা আসতেন পাড়ায় লুকিয়ে চুরিয়ে, এ দিন তাঁরা এসেছিলেন দলে দলে বাস-ম্যাটাডোর নিয়ে! বামেদের গাড়ি ভাড়া দিলে সমস্যায় পড়তে হবে, গাড়ি-মালিকদের এই ভয়ও এখন ভাঙছে বলে সিপিএম নেতা-কর্মীদের বক্তব্য। এমনকী, ভয় ভাঙার নমুনা রেখে মেট্রোতেও ব্রিগেড-জনতা চড়েছে স্লোগান দিতে দিতে!

ব্রিগেডে আসার পথে বিপত্তি। গঙ্গায় হাত থেকে পড়ে গেল ব্যাগ।

দর্শক পুলিশ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

তার মানে এই নয়, শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ থেমে গিয়েছে! ব্রিগেডে আসার পথে এ দিন হাড়োয়ায়, ভাঙড়ে সিপিএম কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ফেরার পথেও আক্রমণের অভিযোগ এসেছে ভাঙড় থেকে। কিন্তু এ বার হামলা উপেক্ষা করেই ব্রিগেডমুখী হয়েছেন সিপিএম সমর্থকরা। ন’মাস আগে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছিল। একরোখা মেজাজ এবং ভিড়ে এ দিনের সমাবেশ তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, এর কারণ মূলত দু’টি। এক, সাড়ে চার বছর ধরে মার খেতে খেতে কর্মীদের অনেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সে জন্যই এ দিন সমাবেশে দেখা গিয়েছে, ফেস্টুনে লেখা, ‘মারবে মারো, পরোয়া করি না। ব্রিগেডের পথে আমি।’ তা ছাড়া, ভোটের মুখে নির্বাচন কমিশনের নজরদারির কথা মাথায় রেখে দলীয় কর্মীদের সংযমের বার্তা দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামপন্থী কর্মীরা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারও করেছেন!

ব্রিগেডের জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ বিজয়রাঘবন। বিড় বিড় করে বলেছেন, ‘‘কেরলে বসে খবর পাই, এখানে আমাদের পার্টি কর্মীদের উপরে কত আক্রমণ হয়েছে। দিল্লিতে, আমাদের রাজ্যে এখানকার কমরেডদের জন্য একাধিক সহমর্মিতার কর্মসূচি নিয়েছি। তবে আক্রমণ সত্ত্বেও এত মানুষ আসতে পারেন, মাঠে এসে সেটা স্বচক্ষে না দেখলে ভাবতে পারতাম না!’’ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার আবার অনেকটা এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর ঢঙে বলেছেন, ‘‘ব্রিগেড ভরে ইতিহাস গড়েছেন। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই! এ রাজ্যের সরকারকেও পাল্টাতে হবে।’’

সরকার যে পাল্টাতে হবে এবং তার লড়াই শুরু করতেই যে ব্রিগেড, তার সুর এ দিন সকাল থেকেই বেঁধে দেওয়া ছিল রাজ্যের নানা দিক থেকে আসা ব্রিগেডমুখী মিছিলে। লাল পতাকা-ফেস্টুন লাগিয়ে, স্লোগান দিতে দিতে দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে ভোর থেকেই ব্রিগেডমুখী হয়েছে হাজারে হাজারে বাস। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘ব্রিগেডে সিপিএমের জনসভায় রাজ্যবাসী ফ্লপ শো দেখলেন। জনমানবশূন্য জনসভা হয়েছে ব্রিগেডে! কর্মীরাও নেতাদের বক্তৃতায় আশ্বস্ত হননি। মানুষ যখন উৎসবে মেতে রয়েছেন, তখন রাজ্যবাসীকে অসুবিধায় ফেলতে এই কর্মসূচি করা হয়েছে!’’

ব্রিগেড থেকে মমতা-মোদী সখ্য এবং ওই দুই শিবিরের বিরুদ্ধেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অভিযোগ তুলেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। যার জবাবে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলে যাঁরা ধর্মের নামে দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের মুখে এ সব কথা মানায় না।’’ (সহ-প্রতিবেদন: ঋজু বসু)

স্লোগানে বুদ্ধ

নিজস্ব সংবাদদাতা: আগে তিনিই ছিলেন মুখ্য বক্তা। ইদানীং প্রকাশ্য কর্মসূচিতেই বেরোন কম। ব্রিগেডে রবিবারও সভাপতি হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা হতেই প্রভূত হাততালি পড়ল। কিন্তু নিজেকে এ বার অন্য ভূমিকায় পেশ করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! সভাপতির দায়িত্ব পালন করে জনতার মন বুঝে সভায় শেষ বক্তা হিসাবে মাইক ধরলেন। মাত্র মিনিট তিনেকের চাঁছাছোলা ভাষণ। কিন্তু তার মধ্যেই তিন দফায় স্লোগান! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘তৃণমূল হঠাও’! জনতা যোগ করছে, ‘বাংলা বাঁচাও’! বুদ্ধবাবু বলছেন, ‘এ লড়াই লড়তে হবে’। প্রতিধ্বনি হচ্ছে, ‘এ লড়াই জিততে হবে’! জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্লোগান দিতে দেখতে বাঙালি অভ্যস্ত। কিন্তু স্লোগানের সূত্রধর বুদ্ধ? অতীত থেকে মনে করতে পারছেন না তাঁর সহকর্মীরাও!

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

ফেরার যুদ্ধে জোড়া কৌশল সিপিএমের

কৌশলে জোটের পথ খুলল প্লেনাম-প্রস্তাবে

সূর্যের হুঁশিয়ারি, তারুণ্যে হোঁচট দলেই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Left Brigade Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE