ডেলো পাহাড়ের বাংলোয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সুদীপ্ত সেনের বৈঠকেরও তদন্ত করবে সিবিআই।
আজ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা জানিয়েছেন, ওই বৈঠকের বিষয়ে তিনি জানেন। জেলে বন্দি সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের দাবি, কালিম্পঙের ডেলো-র সরকারি বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও। এ নিয়ে সিবিআই অধিকর্তাকে আজ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ওই বৈঠকের কথা আমিও জানি।”
২০১২ সালের ১ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুপুর ১২টা নাগাদ দার্জিলিঙের রিচমন্ড হিল থেকে রওনা দিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ কালিম্পঙের ডেলোয় পৌঁছন। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ওই দিনই রাত ১২টা নাগাদ দু’টি গাড়ি ঢোকে বাংলোয়। তার একটিতে ছিলেন সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। রাত দেড়টা নাগাদ গাড়ি দু’টি বাংলো থেকে বেরিয়ে যায় বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেলে বসে কুণাল যে ৯১ পাতার বিবৃতি লিখেছেন, সেটি এখন সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের কাছে রয়েছে। কুণালের ওই ‘জবানবন্দি’-র প্রতিটি বাক্য খুঁটিয়ে পড়ছেন তদন্তকারীরা। সিবিআইয়ের শীর্ষস্তরের নির্দেশ, তৃণমূলের ওই রাজ্যসভা সাংসদের বক্তব্যের সূত্র ধরে তদন্ত করা হোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর কোনও চুক্তি হয়েছিল কি না, পর্যটন বা অন্য কোনও ব্যবসায় সারদাকে কোনও বরাত দেওয়া হয়েছিল কি না, তার তদন্ত চলছে। এই ধরনের চুক্তি হয়ে থাকলে সেখানে সারদাকে পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সারদাকে ব্যবসা করতে রাজ্য সরকারের তরফে জমি বা অন্য ভাবে বিশেষ কোনও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না, তদন্ত হবে তারও। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, “ঠিক যে ভাবে মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তির তদন্ত হচ্ছে, তেমনই মমতার আমলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সারদার কোনও চুক্তি হয়েছিল কি না, হয়ে থাকলে তার খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা হবে।”
সিবিআই কর্তারা নিশ্চিত, সুপ্রিম কোর্ট সারদা-কাণ্ডের পিছনে যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সন্ধান করতে বলেছে, তার শিকড় রয়েছে রাজনৈতিক স্তরে। সেই শিকড়ের খোঁজে নেমে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের যোগাযোগের সূত্রগুলি বের করতে চাইছে সিবিআই। প্রথমে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব-কর্তা দেবব্রত সরকারকে গ্রেফতার, তার পরে আজ রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি তথা তৃণমূলের অন্যতম সহ-সভাপতি তথা দলের তরফে বীরভূমের পর্যবেক্ষক রজত মজুমদারকে গ্রেফতার তারই অঙ্গ। সিবিআই মনে করছে, এঁদের মাধ্যমেই সারদা-র সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগাযোগের আরও সূত্র মিলবে।
সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা বলেন, “আমাদের তদন্ত একদম সঠিক দিকে এগোচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফল মিলবে।” কত তাড়াতাড়ি, তা নিয়ে অবশ্য তিনি মুখ খুলতে চাননি। আগামী নভেম্বরের শেষে সিবিআই-অধিকর্তার পদ থেকে তাঁর অবসর নেওয়ার কথা। সুপ্রিম কোর্ট সারদা ছাড়াও সমস্ত বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সিবিআই-কে। মনে করা হচ্ছে, অবসরের আগে অন্তত সারদা-কাণ্ডের বিষয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করে যেতে চাইছেন রঞ্জিত। কুণাল ঘোষ তাঁর বিবৃতিতে লিখেছেন, রোজভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুর সঙ্গেও ওই ডেলো পাহাড়ের বাংলোতেই মমতার বৈঠক হয়েছিল। অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তের সময় এই দিকটি দেখা হবে।
কুণাল ঘোষের অভিযোগ, সারদা মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা সবচেয়ে বেশি যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্টো দিক থেকে সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের পর্যবেক্ষণ হল, যিনিই সারদা-র বিভিন্ন সংস্থায় কোনও না কোনও পদাধিকারী, তিনিই আবার পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কুণাল ঘোষ ছিলেন সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও। তাঁকে পরে রাজ্যসভার সাংসদ করেন মমতা। একই ভাবে সারদা গোষ্ঠীর ‘কলম’ পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরানকেও মমতা সম্প্রতি রাজ্যসভায় নিয়ে এসেছেন। মিঠুন চক্রবর্তী, শতাব্দী রায়, অর্পিতা ঘোষের মতো আরও বেশ কয়েক জন তৃণমূল সাংসদ এবং তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে সারদা-র যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। সারদা-র সঙ্গে ব্যবসায়িক বা অন্যান্য যোগাযোগ ছিল, এমন কয়েক জন মমতার মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পেয়েছেন।
তদন্তে সারদা-তৃণমূল যোগসূত্র যত স্পষ্ট হচ্ছে, ততই মমতা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতারা সিবিআই-কে আক্রমণের মাত্রা বাড়াচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, সিবিআই রাজনীতি করছে। তদন্ত সঠিক পথে এগোচ্ছে না। সিবিআই কর্তাদের পাল্টা দাবি, যেমন যেমন তথ্য মিলছে, নথি মিলছে, তার সূত্র ধরেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সারদার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে তবেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সিবিআই অধিকর্তার কথায়, “প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য আমাদের হাতে আসছে। ঠিক রাস্তাতেই তদন্ত যাচ্ছে।”
সিবিআইয়ের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, সারদা-তদন্তের অভিনবত্ব হল, এখানে বড় কোনও রহস্যভেদ হওয়ার নেই। সারদা কী ভাবে মানুষকে প্রতারিত করেছিল, সারদা কর্ণধারের সঙ্গে কাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাঁরা কী ভাবে সারদাকে সাহায্য করেছেন, সারদা-র থেকে তাঁরা কী সুবিধা পেয়েছেন, তা মোটামুটি ভাবে সকলেরই জানা। কিন্তু সে সব প্রমাণ করার জন্য নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ চাই। সারদার আর্থিক লেনদেন অনেকটাই নগদে হয়েছিল। সারদা-র পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করে তা সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণ করতে হলে নথিপ্রমাণ প্রয়োজন। সিবিআই সে সব জোগাড় করারই চেষ্টা করছে।
টু-জি স্পেকট্রাম ও কয়লা বণ্টন মামলার তদন্তে সিবিআই-অধিকর্তা নিজেই এখন যথেষ্ট চাপে। ওই দু’টি তদন্তে রঞ্জিত সিন্হার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু সিবিআই-অধিকর্তা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হলেও সারদা-র মতো কেলেঙ্কারির তদন্তে তার কোনও প্রভাব পড়ছে না। তদন্তের কাজ যেমন চলার তেমনই চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy