প্রিয় নেতার সঙ্গে নিজস্বী। মেদিনীপুর শহরে বাম পদযাত্রায়। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
মুগের জিলিপি আর মুড়ি দিয়ে প্রাতরাশে হঠাৎ বিরতি পড়ল। ঠোঙা হাতে আসরাফুল শেখের সবিস্ময় প্রতিক্রিয়া, ‘‘উ-রি-বা-বা! আবার সিপিএম!’’ কেশপুর বাজারে আসরাফুলের অদূরে তখন জোড়হাতে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। প্রতি নমস্কারের জন্য আসরাফুলের হাতটা উঠতে গিয়েও আবার মুড়ির ঠোঙায় ফিরে গেল! রাস্তার ও’পারে কারা সব মোবাইল হাতে ছবি তুলছে!
এই কেশপুরকেই ২০০১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘সিপিএমের শেষপুর’। তার ১৫ বছর পরে কেশপুরের বিধায়ক এখনও সিপিএমের! যদিও রাজ্যে পরিবর্তনের পরে গত পাঁচ বছর এখানে বামেদের তেমন কর্মসূচি নেই। ক’দিন আগেও মিছিলে হামলা হয়েছে। সিপিএমের ‘রাজনৈতিক মৃত্যু’ জানান দিতে এই জানুয়ারিতেও চন্দ্রকোনা থেকে কেশপুর হয়ে মেদিনীপুর পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে দে়ড় দশক আগের সেই তৃণমূল-সিপিএম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ছবি পোস্টার করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে-পিছে ভারতী ঘোষের উর্দিধারী বাহিনী, দু’ধারে পোস্টারের নজরবন্দি— মাঝখান দিয়ে সূর্যবাবুর নেতৃত্বে শালবনির দিকে চলেছে রবীন দেব, তরুণ রায়, সন্তোষ রানাদের ‘শিল্প চাই’ পদযাত্রা।
এই অবস্থায় কী করতে পারত বহু যুদ্ধের সাক্ষী কেশপুর?
বৃহস্পতিবার শীতের সকালটা কেশপুর রাস্তার পাশে, বাড়ির দাওয়ায়, দোকানের ছাদে দাঁড়িয়ে পড়ল। কঠিন চোখমুখ। কষ্ট করে কখনও সখনও একটু কাষ্ঠহাসি। সাড়া দেব কি দেব না-র টানাপড়েন সাদা চোখেই স্পষ্ট! মিছিল যাচ্ছে যেন প্রস্তর শহরের ভিতর দিয়ে!
সুকুমার সেনগুপ্ত মহাবিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার পরে একটু একটু করে যেন আড় ভাঙার ইঙ্গিত। গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লেন এক শিক্ষিকা। উল্টো দিক থেকে আসছে মিছিল। শিক্ষিকা এগিয়ে গেলেন সূর্যবাবুর দিকে। জানতে চাইলেন, ‘‘আপনারা আসেন না কেন?’’ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের নেতারা বুঝতে পারছিলেন, ভয়ের জোব্বায় শরীর ঢুকিয়ে রেখেছে এলাকাটা! এর পর একের পর এক বাস দাঁড়াচ্ছে আর মিছিল থেকে নেতারা বাসযাত্রীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ছেন, ‘‘কী, ভয় করছে?’’ নেমে এসে এক বাস কন্ডাক্টর সটান এগিয়েও এলেন উত্তর দিতে। ‘‘ভয়ের কী আছে? এই তো হাত মেলাচ্ছি!’’ সূর্যবাবুর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে আবার ফিরে গেলেন বাসের দিকে। দশম শ্রেণির ছাত্রী পুনম পরভিন বিরোধী দলনেতার দিকে সই করার সাদা খাতা বাড়িয়ে দেওয়ার পরে তার পরিবারের লোকজনও সহাস্য অভিবাদন জানানোর সাহস পেলেন!
জামতলা পার করে যাওয়ার পরে অবশ্য পদযাত্রা আবার কয়েক দিনের চেনা চেহারায়। মাঝেমধ্যেই এগিয়ে আসছেন স্থানীয় মানুষ, ফুল দিচ্ছেন, মালা পরাচ্ছেন। মাঝপথেই পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া থেকে আসা মিছিল মিশে গেল শালবনিমুখী পদযাত্রার সঙ্গে। মেদিনীপুর শহর হয়ে সূর্যবাবু, দীপক সরকার, তাপস সিংহেরা যখন এগোচ্ছেন, তখন তো মিছিল সমুদ্রের মতো! যে মিছিল এ দিনের মতো যাত্রা শেষ করেছে ভাদুতলায়। আজ, শুক্রবার শালবনি পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে তার পরে সমাবেশ এবং শিল্পের জন্য হাঁটার আপাতত ইতি।
মিছিল শুরুর আগেই জামশেদ ভবনে দাঁড়িয়ে কেশপুরের সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দলুই বলছিলেন, ‘‘মানুষ ভোটটা দিতে পারলে দেখবেন, এ বারেও কী হয়!’’ তাপসবাবুর কথায়, ‘‘কেশপুর তো সন্ত্রস্ত। এত দিন বাদে আমরা এমন বড় মিছিল করলাম এখানে। ভয় ভাঙতে সময় তো লাগবেই।’’ আর কলকাতায় এ দিনই বাম গণসংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ বিপিএমও-র আহ্বায়ক শ্যামল চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘মানুষের ভয় ভাঙছে। পুলিশ-প্রশাসনও বুঝতে পারছে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে! তাই এ বারের যাত্রাপথে পুলিশ-প্রশাসনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’’ তাঁর আরও দাবি, পদযাত্রার পথে সর্বত্রই তাঁরা যত আশা করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ হবে।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির সাংসদ যদিও পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘একটা জাঠা করলেই লোকে সব ভুলে যায় নাকি? কেশপুর থেকে নেতাই, সব ঘটনাই মানুষ মনে রেখেছেন।’’ মানুষ যে মনে রাখেন, বিলক্ষণ জানেন এই জেলারই ভূমিপুত্র সূর্যবাবু। এটাও জানেন, জনস্মৃতিতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যোগও হয়! দিনের শেষে সূর্যবাবু তাই বলছেন, ‘‘সহজ পথে মিছিল ছিল না আমাদের। আঁকা-বাঁকা, কঠিন রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছি। যেতে যেতেই ওঁদের দিকে হাত নেড়ে, নমস্কার করে মানুষের মনের ভাব আঁচ করার চেষ্টা করেছি।’’
মনের হদিশ কয়েক মাস পরে ইভিএম দেবে নিশ্চয়ই! তার আগে হাতটা তো বাড়িয়ে রাখা গেল!
ভারতীর পুলিশকেও লজেন্স
তিন দিন আগে হুগলিতে পদযাত্রায় সামিল বাম নেতা-কর্মীদের লজেন্স, চ্যুইংগাম, জল খাইয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা। এ বার পদযাত্রার পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীদের জল-লজেন্স খাওয়ালেন সিপিএম নেতারা। সৌজন্যের এই ছবি দেখা গেল পশ্চিম মেদিনীপুর, যেখানে পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ! বৃহস্পতিবার সকালে কেশপুর থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। নেতৃত্বে ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব, জেলা সম্পাদক তরুণ রায়। সওয়া বারোটা নাগাদ আমড়াকুচি পেরনোর পরে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিজয় পাল হাঁক পাড়লেন, ‘ট্যাবলোয় জল-লজেন্স রাখা আছে। নিয়ে আয় তো।’ ছাত্র-যুব নেতারা সকলের সঙ্গে পুলিশকর্মীদেরও লজেন্স দিলেন। হাসিমুখে লজেন্স নিলেন মিছিল আগলানোর দায়িত্বে থাকা ডেপুটি পুলিশ সুপার মনোরঞ্জন
ঘোষ ও তাঁর সহকর্মীরা। যে জেলায় পুলিশের বিরুদ্ধে বিরোধীদের গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ, সেখানে এই দৃশ্য? সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণবাবু বলছেন, “পুলিশকর্মীরাও তো হাঁটছেন। তেষ্টা মেটাতে এই ব্যবস্থা।” এই প্রসঙ্গে ভারতীদেবীর বক্তব্য, “এ নিয়ে কিছু বলার নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy