Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অঙ্গ ঘায়েল করে আরও ভয়াল হচ্ছে ডেঙ্গি

চলে যাওয়ার সময় পার করে দিব্যি ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকছে। শুধু তা-ই নয়, যাওয়ার আগে এমন মারাত্মক ছোবল মেরে যাচ্ছে যে, শয্যা নিতে হচ্ছে বেশ কিছু দিনের জন্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

চলে যাওয়ার সময় পার করে দিব্যি ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকছে। শুধু তা-ই নয়, যাওয়ার আগে এমন মারাত্মক ছোবল মেরে যাচ্ছে যে, শয্যা নিতে হচ্ছে বেশ কিছু দিনের জন্য।

ডেঙ্গির এ হেন ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ই এখন ডাক্তারদের কাছে ত্রাস। তাঁরা বলছেন, জ্বর কমার পরেই রোগটি আসল খেল দেখাচ্ছে। মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে হার্ট, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, প্যাংক্রিয়াস— কোনও অঙ্গকেই রেহাই দিচ্ছে না।

যেমন বেলঘরিয়ার এক আবাসনের কেয়ারটেকার শ্যামলকুমার মাজি। ডেঙ্গি ধরা পড়ায় বাড়ির লোক ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাগর দত্ত মেডিক্যালে। সেখানে ভর্তি নেওয়া হয়নি। আপাতত এক বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে আছেন। মলদ্বারে দগদগে ঘা, সংক্রমণ। অসহ্য জ্বালায় ছটফট করছেন। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গির থাবায় ওঁর অন্ত্রেও ঘা হয়েছে। ‘‘ডেঙ্গিতে এ তল্লাট ছেয়ে গিয়েছে। অনেকের বিভিন্ন অঙ্গ জখম। কেউ ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। কেউ লিভারের গণ্ডগোলে জেরবার।’’— মন্তব্য এক আবাসিকের। ওঁদের খেদ, এই সঙ্কটেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গির পরে অন্য নানা ধরনের উপসর্গই ভোগাচ্ছে বেশি। পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, এগুলো হলো ‘সুপার অ্যাডেড ইনফেকশন।’ অর্থাৎ, একটা রোগকে ভর করে অন্যদের হামলা। অমিতাভবাবুর কথায়, ‘‘সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ফুসফুস। নিউমোনিয়া হচ্ছে অনেকের। মূত্রনালির সংক্রমণ আকছার। মেনিনজাইটিসও হচ্ছে অনেকের।’’ কিছু ডেঙ্গি-রোগী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে তা সাময়িক।

অন্য দিকে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অশোকানন্দ কোনার ও অভিজিৎ চৌধুরীর বক্তব্য— ডেঙ্গি ভাইরাস এমনিতেই লিভারের প্রদাহ তৈরি করে। সেটাই হচ্ছে। জ্বর চলাকালীনই লিভারের সমস্যায় ভুগছেন অনেকে। মেডিসিনের চিকিৎসক বিনয় গুছাইত বলেন, ‘‘স্নায়ুর অসুখ দেখতে পাচ্ছি। খিঁচুনি ছাড়াও প্যাংক্রিয়াটাইটিস, হেপাটাইটিস নিয়ে অনেকে আসছেন।’’

বস্তুত, ডেঙ্গি-আতঙ্কে নয়া মাত্রা যোগ করেছে এই সব সংক্রমণ। সোমবারও মৃত্যু হয়েছে এক জনের। এ দিন ভোরে আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান কসবার রাজডাঙা মেন রোডের বাসিন্দা মিন্টু মণ্ডল (৪০)। পরিবার জানাচ্ছে: ডেঙ্গি ধরা পড়ার বেশ ক’দিন বাদে তাঁর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল। সল্টলেক ও বাইপাসের বহু হাসপাতালে ডেঙ্গি-পরবর্তী নানান সংক্রমণ নিয়ে কয়েকশো রোগী ভর্তি।

ডেঙ্গি-পরবর্তী সংক্রমণের ভুরি ভুরি ‘কেস’ হাজির দক্ষিণ দমদমে। কয়েকশো মানুষ ডেঙ্গির পরে কিডনি-লিভারের গুরুতর সমস্যায় ভুগছেন। ডেঙ্গি নিয়ে রবিবার বাইপাসের এক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জয়ন্তী সেনশর্মা। হাসপাতালের খবর, ভর্তির সময়ে তাঁর প্লেটলেট কাউন্ট ছিল ৪৮ হাজার। পরে এক লাফে নেমে যায় ২২ হাজারে। প্রসঙ্গত, চলতি মরসুমে দক্ষিণ দমদম পুর-এলাকায় ডেঙ্গির বলি ১০।

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গির চরিত্র যা দাঁড়িয়েছে তাতে, রোগ ধরা পড়ার পরে রোগীকে নিরন্তর পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। কিন্তু অভিযোগ, সরকারের ‘লুকোচুরি’র কারণে ডেঙ্গির দাপটের কথা স্বীকার পর্যন্ত করা হচ্ছে না। ফলে পর্যবেক্ষণের বালাই নেই। সংক্রমণও অবাধ। পতঙ্গবাহী রোগ প্রতিরোধ বিভাগের অন্দরের খবর, ডেঙ্গিতে হাজার-হাজার আক্রান্ত এবং একশোর বেশি মৃত্যু সত্ত্বেও পরিসংখ্যান চেপে যাওয়া হচ্ছে। তার কারণ হিসেবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তোতাপাখির মতো আওড়াচ্ছেন ‘ভ্যালিডেট’ শব্দটি। বোঝাতে চাইছেন, এত মানুষের ডেঙ্গি সংক্রমণ বা ওই রোগে মৃত্যুর তথ্য এখনও প্রমাণিত নয়। এটা খতিয়ে দেখছে (ভ্যালিডেট) স্বাস্থ্য দফতর। তারা নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত ওই পরিসংখ্যান গ্রাহ্য করা হবে না। ‘ভ্যালিডেট’ করার পন্থা কী, কত দিনের মধ্যে শেষ হবে, সে সব সম্পর্কে অবশ্য স্বাস্থ্যকর্তারা খোলসা করে কিছু বলছেন না।

তাই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়লেও সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি মরসুমে রাজ্যে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ৮ হাজার। মৃত সাকুল্যে ২৮। যেখানে বাইপাসের এক হাসপাতাল জানাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ওখানেই ১৭ জন ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন! ‘‘এতেই কারচুপির ছবিটা স্পষ্ট।’’— মন্তব্য এক স্বাস্থ্য-আধিকারিকের।

এখানেই শেষ নয়। একাধিক মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর: এ যাবৎ ডেথ সার্টিফিকেটে ‘ডেঙ্গিতে মৃত্যু’ লেখার উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। ক’দিন হল, ‘ডেঙ্গি-আক্রান্ত’ লেখাতেও নিষেধাজ্ঞা চেপেছে। তাই প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টে ডেঙ্গির বদলে থাকছে ‘ভাইরাল ফিভার।’ বলা হচ্ছে, ‘‘ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া।’ মানে, জ্বরের সঙ্গে প্লেটলেট কমছে। ডাক্তারেরা পরিজনদের বোঝাচ্ছেন, ভাইরাল ফিভারেও প্লেটলেট কমে।

রোগের প্রকোপ ধামাচাপা দেওয়ার এই হিড়িকে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে বলে আক্ষেপ করছেন চিকিৎসকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Mosquito
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE