ছবি: সংগৃহীত।
খামখেয়ালে ইতিহাসের মহম্মদ বিন তুঘলককেও সে যে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে, আবার তার প্রমাণ দিল প্রকৃতি। মাত্র সাত দিনেই প্রায় আমূল বদলে গেল আবহাওয়া!
গত ১ ডিসেম্বর, শুক্রবার কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ১৪.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর তা আবার সটান উঠে গেল ২০.৪ ডিগ্রিতে!
গত সপ্তাহে কলকাতার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে শুকনো ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়া। আর এ দিন মহানগর-সহ গাঙ্গেয় বঙ্গে তার জায়গা নিয়েছে সমুদ্র থেকে আসা ভেজা বাতাস!
দিন দুয়েক আগেও সূর্যের তাপ গায়ে মেখে দাঁড়াতে ভাল লাগছিল। রাতে আর ভোরে গায়ে দিতে হচ্ছিল গরম জামা, মুড়ি দিতে হচ্ছিল লেপ-কম্বল। আর শুক্রবার সূর্য মুখ না-দেখানোয় বাইরে বেরোতেই চেপে ধরেছে ঠান্ডা! আবার রাতে তাপমাত্রা না-কমায় তীব্র হচ্ছে অস্বস্তি!!
বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি ওডিশা-অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের কাছাকাছি চলে আসার ফলেই এই গুমোট, এই অস্বস্তিকর আবহাওয়া তৈরি হয়েছে— জানাচ্ছে আবহাওয়া দফতর। তাদের পূর্বাভাস, গভীর নিম্নচাপটি স্থলভূমির আরও কাছে এগিয়ে এলে ভারী বৃষ্টি হতে পারে ওডিশা ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। আজ, শনিবারেই সেটি স্থলভূমিতে ঢুকবে, মনে করছেন আবহবিদেরা।
এর ফলে কী হতে পারে? হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, অন্ধ্র, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র আগামী দু’দিন উত্তাল থাকবে। মৎস্যজীবীদের তাই সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। আজ, শনিবার এবং কাল, রবিবার গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের একাংশে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। স্থলভূমিতে ঢুকে নিম্নচাপটি কোন দিকে এগোয়, তার উপরে নির্ভর করছে আগামী সপ্তাহের তাপমাত্রা। মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পুরোপুরি পরিষ্কার না-হলে তাপমাত্রা তেমন কমার সম্ভাবনা দেখছেন না আবহবিদেরা। অর্থাৎ? হেমন্তেই শীত আগাম দাক্ষিণ্যের যে-হাত বাড়িয়েছিল, আপাতত তা প্রায় গুটিয়েই নিচ্ছে। অর্থাৎ? ডেঙ্গি-জ্বরের মতো পতঙ্গবাহিত রোগব্যাধির মোকাবিলায় যাকে ত্রাতা মনে করা হচ্ছিল, সেই শীতের জন্য আবার প্রার্থনায় বসা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
চলতি বছরে পরের পর নিম্নচাপ, নিম্নচাপ অক্ষরেখা, ঘূর্ণাবর্ত ঘনিয়ে এনে বারবার নাস্তানাবুদ করে চলেছে প্রকৃতি। শীতের হাত উপুড় করেও তা গুটিয়ে নেওয়ার মূলেও আছে এক গভীর নিম্নচাপ। এর কারণ হিসেবে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারিকুরি এবং তার জেরে জলবায়ু বদলের কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীন সংস্থা ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি-র রিপোর্টেও সে-কথাই বলা হয়েছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে ক্রমশ ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপের প্রকোপ বাড়বে। এক আবহবিজ্ঞানীর মতে, সাগরের জলের তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রির বেশি হলেই শক্তিশালী নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে সাগরজলের তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই এমন উপদ্রব সইতে হবে।
দিল্লির মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা অবশ্য আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে কোনও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁদের ব্যাখ্যা, বর্ষা বিদায়
এবং শীত জাঁকিয়ে বসার মধ্যবর্তী সময়টা ঘূর্ণিঝ়ড় বা গভীর নিম্নচাপ তৈরির পক্ষে আদর্শ। তাই এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে অনেক পরিবেশবিজ্ঞানী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৩ সালে দু’মাসের পরপর চারটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় জন্ম নিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। ফি-বছরই দেখা যাচ্ছে, খাতায়-কলমে বর্ষা বিদায়ের পরেও নিম্নচাপের বৃষ্টি চলছেই। ঋতুচক্রের ইতিবৃত্তে বর্ষা ও শীতের মাঝখানে হেমন্ত নামে যে-ঋতুর কথা বলা আছে, তার অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। ডিসেম্বরেও বৃষ্টি এসে ঠেলে ঠেলে পিছিয়ে দিচ্ছে শীতকে।
‘‘এমন বদল হতে থাকলে শীতটাও বোধ হয় হারিয়ে যাবে,’’ আক্ষেপ এক পরিবেশবিজ্ঞানীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy