প্রতীকী ছবি।
তাঁর জন্ম, শৈশব, বেড়ে ওঠা এ রাজ্যে। স্কুল, মেডিক্যাল কলেজ, চিকিৎসক হিসেবে পেশা-জীবন— তা-ও এই বাংলাতেই। তবু মাথা গোঁজার জন্য খাস কলকাতা শহরে তিনি ভাড়ায় ঘর পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ! কারণ? তিনি সংখ্যালঘু।
নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে চিঠি দিয়েছেন ওই সরকারি চিকিৎসক। কলকাতারই এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওই শিক্ষক-চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘‘ভাড়ায় ঘর চাই শুনে গোড়ায় প্রায় কোনও বাড়ি-মালিকই আপত্তি করেননি। কিন্তু পরে নামটা শুনেই মুখ ফিরিয়ে নেন তাঁদের প্রত্যেকেই!’’ নিজের এই অভিজ্ঞতাকে কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না ওই চিকিৎসক।
মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাসের মতো কিছু এলাকা বাদ দিলে এই শহরের অন্যত্র মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া নিয়ে সমস্যা সেই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। অতীতে সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ক্ষুব্ধ লেখক তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘আমি মুসলমান, না লেখক?’’ একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল জাতীয় স্তরের এক সাংবাদিকেরও। বাড়ি খুঁজে হন্যে হয়েছিলেন এক জনপ্রিয় গায়কও।
প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা দিয়ে এ রাজ্যে ৩৪ বছর রাজত্ব করেছে বাম সরকার। তাদের হটিয়ে গত সাত বছর যারা ক্ষমতায় রয়েছে, তাদেরও চেতনার রঙে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার সুর। তা হলে কেন শুধু ধর্ম-পরিচয়ের জন্য আটকে যেতে হয় মুস্তাফা সিরাজ, ওই সাংবাদিক, গায়ক এবং আরও অনেককে?
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গায়কের পরে একই প্রশ্ন তুলছেন রেজাউল করিম নামে ওই চিকিৎসক। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘যেখানেই যাই, প্রাথমিক কথাবার্তায় সকলেই সন্তুষ্ট হন। তার পরে যেই আমার নাম শোনেন, তখনই বলেন, আপাতত বাড়ি ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কেউ বা বলেন, ‘পরে খবর দেব।’ সেই ‘পর’ অবশ্য আর আসে না।’’ ওই চিকিৎসক জানান, দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িতে তাঁর নাম শোনার পরে গৃহকর্তা বলেন, ‘আমার স্ত্রী বাড়িতে পুজোআর্চা করেন তো। আপনাকে তাই বাড়ি ভাড়া দিতে পারব না।’
আরও পড়ুন:মেয়ে পাচার রুখতে বিশ্ব-তহবিল দুই বোনের
রেজাউলের বাড়ি বীরভূমে। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জেলায় থেকেছেন। ২০০৩ সাল থেকে কলকাতার হেস্টিংসে সরকারি আবাসনে সপরিবার ভাড়ায় থাকছেন তিনি। অভিযোগ, সেই আবাসনের একাধিক অংশ ভাঙা। ভেঙে গিয়েছে সিলিং-ও। বর্ষায় জল পড়ছে ঘরে। গত দশ বছরে একাধিক বার সরকারি দফতরে সে-কথা জানিয়েও ফল হয়নি। চলেছে টালবাহানা। ‘‘এই ফ্ল্যাটটি এখন কার্যত বসবাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। তাই স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকার জন্য ভাড়াবাড়ি খুঁজছিলাম। কিন্তু ঘর খুঁজতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে অপমান জুটছে। এমনকী আমার নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে,’’ বলেন ওই চিকিৎসক।
যাঁরা রেজাউলকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়ির মালিক। মুসলিম ধর্মাবলম্বীকে ঘর ভাড়া দিতে আপত্তি কোথায়? ফোনে ওই বাড়ি-মালিক বললেন, ‘‘আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। ঝুটঝামেলায় থাকতে চাই না।’’ ঝুটঝামেলা কীসের? এ বার ফোন নামিয়ে রাখেন ওই ব্যক্তি। অন্য এক বাড়ি-মালিকের জবাব, ‘‘আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। তাই ব্যক্তিগত অসুবিধা আছে।’’
সব দেখেশুনে রেজাউলও জেদ ধরেছেন, ‘‘মুসলিম-প্রধান কোনও এলাকায় আমি থাকবো না। এটুকু স্বাধীনতা তো আমার থাকাই উচিত।’’
অ-মুসলিম কোনও বাড়ি-মালিক কবে স্বাগত জানাবেন রেজাউলকে?
জবাব নেই ‘সংস্কৃতির শহর’-এর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy