Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ব্রজভূমি থেকে বাংলা, জন্মাষ্টমী সকলেরই

আজ জন্মাষ্টমী। উৎসবের রেশ মথুরা, বৃন্দাবন, গোকূল কিংবা দ্বারকা সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্র হিমাচল। ব্রজভূমিতে সেই ঝুলন থেকেই শুরু হয়েছে উৎসব। পিছিয়ে নেই বাংলাও। বাঙালির জন্মাষ্টমীতে রয়েছে নিজস্ব কিছু আচার অনুষ্ঠান ও প্রথা। কলকাতার বনেদি পরিবার থেকে মঠ মন্দির, কিংবা মফস্‌সলেও দেখা যায় ভিন্ন মেজাজ। কোথাও দেবতার উদ্দেশে দেখা যায় নাড়ি কাটা অনুষ্ঠান কোথাও বা ভোগের এলাহি আয়োজন।

নৈহাটির শ্রীশ্রী বিজয়রাধাবল্লভজিউ।

নৈহাটির শ্রীশ্রী বিজয়রাধাবল্লভজিউ।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৪৩
Share: Save:

আজ জন্মাষ্টমী। উৎসবের রেশ মথুরা, বৃন্দাবন, গোকূল কিংবা দ্বারকা সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্র হিমাচল। ব্রজভূমিতে সেই ঝুলন থেকেই শুরু হয়েছে উৎসব। পিছিয়ে নেই বাংলাও। বাঙালির জন্মাষ্টমীতে রয়েছে নিজস্ব কিছু আচার অনুষ্ঠান ও প্রথা। কলকাতার বনেদি পরিবার থেকে মঠ মন্দির, কিংবা মফস্‌সলেও দেখা যায় ভিন্ন মেজাজ। কোথাও দেবতার উদ্দেশে দেখা যায় নাড়ি কাটা অনুষ্ঠান কোথাও বা ভোগের এলাহি আয়োজন। এ যেন দেবতার সঙ্গে ভক্তের আত্মিক যোগাযোগ।
জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউর ষোড়শোপচারে বিশেষ পুজো ও হোম হয়। এই পরিবারের গৃহবধূ ঊননব্বই বছরের আরতি দেব বলছিলেন, ‘‘এই উপলক্ষে গোবিন্দজিউকে নতুন কাপড় ও অলঙ্কার পরানো হয়। পুজোয় দেওয়া হয় তাল-সহ বিশেষ নৈবেদ্য। পর দিন জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয় নন্দোৎসব। সে কালে আরও জাঁকজমক সহকারে জন্মাষ্টমী হত’’। স্মৃতি মেদুর আরতি দেবী বলছিলেন, আগে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা রং-চং মেখে মুকুট গয়না পরে নন্দ সাজত। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখাত। এই উপলক্ষে একটা বড় জালায় গোলা হত হলুদ। সেটা সবার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হত। স্নানও করিয়ে দেওয়া হত কাউকে কাউকে। এখন পুরোহিতমশাই সেই হলুদ জল ছিটিয়ে দেন। এ দিনও নতুন করে গোবিন্দজিউকে সাজানো হয়। আগে আসতেন কিছু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা নাম সংকীর্তন করতেন। সে দিনও বিশেষ পুজোর পরে ভোগ আরতি হয়। এখনও গোবিন্দজিউর ভোগে থাকে খাস্তাকচুরি, রাধাবল্লভী, গজা, নিমকি, বালুসাই, লালমেঠাই, মতিচূর, তালের বড়া ইত্যাদি। আগে জন্মাষ্টমীতে ছ’টি রুপোর মুদ্রা উৎসর্গ করা হত। এখন তার পরিবর্তে ছ’টাকা উৎসর্গ করা হয়।
তেমনই দর্জিপাড়া রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে গৃহদেবতা নারায়ণ শিলা রাজরাজেশ্বরের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ষোড়শপচারের বিশেষ পুজো হয়। পুরনো প্রথা অনুসারে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যেমন তার নাড়ি কাটা হয় তেমনই গৃহ দেবতার উদ্দেশে হলুদ সুতো কাটা হয় চাঁচারি দিয়ে। যাতে তাড়াতাড়ি নাড়ি শুকোয় সেই জন্য দেওয়া হয় আদার শোঁট। বিশেষ ভোগে থাকে তালের লুচি, তালের বড়া, লুচি, নানা রকম ভাজা।
মধ্য কলকাতার গোবিন্দ সেন লেনে চুণিমণি দাসীর বাড়িতে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গৃহদেবতা গোবিন্দদেবজিউর উদ্দেশে সন্দেশের তৈরি কেক কাটা হয়। যদিও পরিবার সূত্র জানা গিয়েছে এই প্রথাটি খুব একটা পুরনো নয়। এই পরিবারের তপনকুমার দে জানালেন, জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় রাধাগোবিন্দদেবজিউর দারু বিগ্রহ সিংহাসন থেকে ঠাকুরদালানে বের করে এনে দুধ, মধু আতর দিয়ে স্নান করানো হয়। এর পরে নতুন বস্ত্র পরিয়ে সাজসজ্জা করিয়ে বিশেষ পুজো করা হয়। সে দিন ভোগে থাকে লুচি, সুজি, নানা রকম ভাজা, তরকারি তালের বড়া, মিষ্টি ইত্যাদি। পরের দিন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি তিনি একটি হাঁড়িতে দই আর হলুদ নিয়ে সাত বার উঠোন প্রদক্ষিণ করার পরে সেই হাঁড়িটি ফাটানো হয়। সে দিন পায়েস ভোগ দেওয়া হয়।

শোভাবাজার রাজপরিবারের গোবিন্দজিউ।

বনেদি বাড়ির পাশাপাশি কলকাতার অ্যালবার্ট রোডের ইসকনের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে অসংখ্য ভক্তসমাগম হয়। দেবতার নজর কাড়া সাজসজ্জা আর নাম সংকীর্তনের সুরে মেতে ওঠেন ভক্তরা। তেমনই এ দিনে বালিগঞ্জের বিড়লা মন্দিরে বহু মানুষ ভিড় করেন পুজো দেওয়ার জন্য। তবে বাঙালিদের পাশাপাশি কলকাতায় অবাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সাড়ম্বরে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। বড়বাজার, হরিরাম গোয়েঙ্কা স্ট্রিট, সত্যনারায়ণ পার্ক, যদুবাবুর বাজার প্রভৃতি জায়গায় বিভিন্ন মন্দিরে কিংবা সম্ভ্রান্ত অবাঙালি পরিবারগুলিতে পালিত হয় জন্মাষ্টমী ও পরের দিন নন্দোৎসব। দেবতার সাজ-সজ্জা থেকে খাওয়াদাওয়ায় থাকে এলাহি আয়োজন।

তেমনই মফস্‌সলেও জন্মাষ্টমীর ভিন্ন মেজাজ আজও পাওয়া যায়। খড়দহের শ্যামসুন্দরের মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে জাঁকজমক সহকারে পুজো হয়।

নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় শ্রীশ্রী বিজয়রাধাবল্লভজিউর মন্দিরে আজও সাবেক ঐতিহ্য মেনেই পালিত হয় জন্মাষ্টমী। ওই দিন রোহিণী নক্ষত্র থাকাকালীন বিশেষ পুজো হয়। এর পাশাপাশি দেবতাকে নিবেদন করা হয় আট রকমের ভাজা। যেমন খই, আতপচালের চিঁড়ে, ভাজা মটর, কলাই, ছোলা, মুগ, ইত্যাদি। দুপুরের ভোগে থাকে ঘি-ভাত ইত্যাদি পদ। রাতে বিশেষ পুজোর পরে যখন হোম হয় তখন লুচি আর তালের বড়া নিবেদন করা হয়। পরের দিন সাড়ম্বরে পালিত হয় নন্দোৎসব। পুরনো প্রথা অনুসারে এক জন যাদব বংশীয় পুরুষকে দেবতার প্রসাদ গ্রহণ করতে হয়। তিনি কপালে দই আর কাদা মেখে গঙ্গাস্নান সেরে দেবতার অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করতেন। যদিও এখন এটি আর হয় না। তবুও নন্দোৎসবের দিনে হয় বিশেষ পুজো, ভোগ নিবেদন ও কীর্তন।

খড়দহের শ্যামসুন্দরের মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে জাঁকজমক।

কাঁচরাপাড়া ও কল্যাণীর সংযোগস্থলে কৃষ্ণরাই জিউর মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আজও দূর দূরান্ত থেকে বহু ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। জন্মাষ্টমীর রাতে মন্দিরের পিছনে রন্ধনশালায় নারায়ণ শিলাকে নিয়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মানুষ্ঠান, নাড়ি কাটা-সহ ধাপে ধাপে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পুজোর শেষে হয় হোম। পরের দিন নন্দোৎসব।

নদিয়া জেলার চাকদহে এবং শান্তিপুরের বৈষ্ণব পরিবারগুলিতে এবং মঠে সাড়ম্বরে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপের জন্মাষ্টমী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মায়াপুরের ইসকন মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। চলতে থাকে সারারাত ব্যাপী বিশেষ পুজো এবং নাম সংকীর্তন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE