Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অপহরণে ব্যর্থ হয়ে ট্রাকের চাকায় পিষে খুন যুবতীকে!

ঘড়ির কাঁটা তখন সবে আটটা পেরিয়েছে। দিল্লি রোডের পাশ ধরে হাঁটতে থাকা দুই তরুণীর পাশে এসে আচমকাই গতি কমালো মিনি ট্রাকটি। চালকের পাশের দরজা খুলে এক তরুণীর হাত ধরে টানতে শুরু করে দিল ট্রাকের খালাসি। দুই তরুণীর প্রবল বাধায় সে কাজে সফল হল না বটে, কিন্তু যাঁকে নিগ্রহ করা হচ্ছিল, তাঁর উপর দিয়েই ট্রাক চালিয়ে দিল চালক!

জয়ন্তী সোরেন ও পূজা হাঁসদা

জয়ন্তী সোরেন ও পূজা হাঁসদা

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
পোলবা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৮:৫৬
Share: Save:

ঘড়ির কাঁটা তখন সবে আটটা পেরিয়েছে। দিল্লি রোডের পাশ ধরে হাঁটতে থাকা দুই তরুণীর পাশে এসে আচমকাই গতি কমালো মিনি ট্রাকটি। চালকের পাশের দরজা খুলে এক তরুণীর হাত ধরে টানতে শুরু করে দিল ট্রাকের খালাসি। দুই তরুণীর প্রবল বাধায় সে কাজে সফল হল না বটে, কিন্তু যাঁকে নিগ্রহ করা হচ্ছিল, তাঁর উপর দিয়েই ট্রাক চালিয়ে দিল চালক! শুক্রবার রাতে হুগলির পোলবায় এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তরুণী জয়ন্তী সোরেনের (২০)। জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাঁর বান্ধবীও।

কয়েক মাস আগে এই পোলবাতেই দিল্লি রোডের উপর একটি পানশালার দুই যুবক এক স্কুলছাত্রীকে টেনে নিয়ে গিয়ে অত্যাচারের চেষ্টা করায় প্রশ্ন উঠেছিল মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে। শুক্রবার সেই অভিযোগই আরও জোরালো হল। প্রশ্ন উঠে গেল পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।

জয়ন্তী সোরেনের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রের অভিযোগ, পুলিশের একাংশ জয়ন্তীর মৃত্যুকে প্রথম থেকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখাতে চাইছিল। এফআইআরের বয়ান বদল করতেও চাপ দেয়। হুগলির পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘মৃতার আত্মীয়েরা যে ভাবে অভিযোগ করতে চাইছিলেন, তাতে পরস্পর বিরোধিতা ছিল। এতে মামলা লঘু হয়ে যেতে পারত। তাই তাঁদের বুঝিয়ে বলে এফআইআর করানো হয়েছে।’’ পুলিশ সুপার জানান, ঘাতক ট্রাকের চালক রঞ্জিত বৈঠাকে বেলগাছিয়া থেকে ধরা হয়েছে। খালাসিকে ধরতে জোর তল্লাশি শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে খুন ও অপহরণের চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে।

ঠিক কী হয়েছিল শুক্রবার রাতে?

পুলিশ ও পরিবার সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে পোলবার কামদেবপুরের কাছে একটি লজেন্স কারখানার কাজ সেরে ফিরছিলেন জয়ন্তী সোরেন ও তাঁর বন্ধু পূজা হাঁসদা। তাঁদের বাড়ি চুঁচুড়ার সিঙ্গিবাগান এলাকায়। দিল্লি রোডের কামদেবপুর মোড় থেকে অটো ধরে তাঁদের বাড়ি ফেরার কথা। মিনি ট্রাকটি পিছন থেকে এসে গতি কমাতেই খালাসি জয়ন্তীর হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। জয়ন্তী বাধা দেন। বন্ধুকে বাঁচাতে পূজাও জয়ন্তীর একটি হাত ধরে টানতে থাকেন। এই টানাহ্যাঁচড়ায় জয়ন্তী ও পূজা দু’জনেই মাটিতে পড়ে যান। তখনই ট্রাকটি পিষে দেয় জয়ন্তীকে। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। আহত হন পূজাও। তবে তাঁরই চিৎকারে আশপাশের লোকজন এবং কারখানার অন্য কর্মীরা দৌড়ে আসেন। তখনই ট্রাক থামিয়ে চালক ও খালাসি চম্পট দেয়। পূজাকে চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শনিবার হাসপাতালে পূজা বলেন, ‘‘আমি জয়ন্তীর হাত ধরেই হাঁটছিলাম। আমাদের কিছুটা সামনে-পিছনে কারখানার আরও কয়েক জন হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই ওই ঘটনা। আমি চাপা পড়তে পড়তে কোনও মতে বেঁচে গেলেও জয়ন্তীকে বাঁচাতে পারলাম না।’’

জয়ন্তীদের পরিবার একেবারেই হতদরিদ্র। বাবা অসীমবাবু একটি মাশরুম বাগান দেখভালের কাজ করেন। তরুণীর মা ভারতী দেবী বলেন, ‘‘আমিও মেয়ের সঙ্গে ওই কারখানায় কাজ করি। শরীর খারাপ ছিল বলে শুক্রবার কাজে যাইনি। মেয়েটা বেঘোরে মারা গেল! শুনেছি পুলিশ দায় এড়াচ্ছে। আমরা চাই দোষীদের শাস্তি হোক।’’ জয়ন্তীর বাবার ক্ষোভ, ‘‘অন্ধকার নামলেই কি মেয়েরা আর বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না?’’

পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ পূজার পড়শিরাও। তাঁদেরই একজন কার্তিক মহান্তি বলেন, ‘‘হাসপাতালে গিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলে বয়ান লিখে তবেই থানায় যাই। কিন্তু তা পুলিশের পছন্দ হয়নি। পুলিশের কেউ কেউ ওটা নিছক দুর্ঘটনা বলে চালাতে চাইছিল। বয়ানও বদলাতে বলে। শেষে এফআইআর নিলেও কোনও প্রতিলিপি দেয়নি।’’ তিনি জানান, স্থানীয় সূত্রের খবর, গাড়িটি মগরার দিকে যাচ্ছিল। অথচ পুলিশ বলছে উল্টো! কিছু বুঝতে পারছি না।

কয়েক মাস আগে পোলবারই সুগন্ধা মোড়ে স্কুলছাত্রীকে নিগ্রহের জেরে তেতে উঠেছিল এলাকা। ভাঙচুর চালানো হয় সংলগ্ন পানশালায়। এর পরেও রাতের দিল্লি রোডে পুলিশের কেন নজরদারি নেই, সে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা। তবে পুলিশের দাবি, থানা এলাকায় প্রতি রাতেই নিয়ম করে টহলদারি চালানো হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

truck murder polba girl murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE