Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কর্পোরেট পরামর্শে ঢেলে সাজবে স্নাতক সিলেবাস

সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় রাজ্যের ছেলেমেয়েদের পোক্ত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রমে আমূল সংস্কার আনার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। নতুন পাঠ্যক্রমের প্রাথমিক খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট উপদেষ্টা সংস্থার হাতে। যা এক কথায় নজিরবিহীন!

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০৩:১১
Share: Save:

সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় রাজ্যের ছেলেমেয়েদের পোক্ত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রমে আমূল সংস্কার আনার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। নতুন পাঠ্যক্রমের প্রাথমিক খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট উপদেষ্টা সংস্থার হাতে। যা এক কথায় নজিরবিহীন!

গত ১৩ জুন উচ্চশিক্ষা সংসদের বৈঠকে স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রমে বদল আনার সিদ্ধান্ত হয়। স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এত দিন নিজেদের পাঠ্যক্রম ঠিক করত নিজেরাই। শিক্ষক-শিক্ষাবিদরাই এই দায়িত্ব পালন করতেন। পঠনপাঠন সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্য সরকার বা অন্য কোনও সংস্থার মাথা গলানোর প্রশ্নই ছিল না। এ বারই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য অভিন্ন ধাঁচার সিলেবাস তৈরি এবং তার জন্য বাইরে থেকে উপদেষ্টা সংস্থা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিল উচ্চশিক্ষা দফতর। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং, ফিডব্যাক ইনফ্রা, আইএলএফএস, কেপিএমজি বা প্রাইসওয়াটার হাউস কুপার্সের মতো কোনও কর্পোরেট উপদেষ্টা সংস্থা নিয়োগ করে পাঠ্যক্রমের খসড়া কাঠামো তৈরি করা হবে। সেই খসড়া দেখে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দেবেন, তার ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে প্রথমে বিজ্ঞান ও পরে কলা শাখার পাঠ্যক্রম তৈরির পরামর্শ দেওয়া হবে বলে বিকাশ ভবন সূত্রের খবর।

প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, বিজ্ঞানের বিষয়গুলির জন্য তিন মাসের মধ্যে প্রথম খসড়া তৈরি করবে উপদেষ্টা সংস্থা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তা পেশ করা হবে উচ্চশিক্ষা সংসদে। সংসদ তা চূড়ান্ত করে পাঠাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে। শুক্রবারই এই বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছে। ১৪ জনের এই কমিটির মাথায় রাখা হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমিতাভ রায়চৌধুরীকে।

রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গত কয়েক দশকে উচ্চশিক্ষার দিকে ফিরেও তাকায়নি বামফ্রন্ট সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে যত বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, গত ৪০ বছরে তা হয়নি। কিন্তু মান্ধাতার আমলের পাঠ্যক্রমের জন্য বাংলার ছেলেমেয়েরা সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছে না। তাদের যোগ্য করে তুলতেই নতুন পাঠ্যক্রম ভাবা হচ্ছে।’’ ‌শিক্ষামন্ত্রী জানান, গোটা রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা যাতে একই মানের শিক্ষার সুযোগ পায়, সেই উদ্দেশ্যে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অভিন্ন কাঠামো চালু করতে চায় সরকার। উচ্চশিক্ষা সচিব বিবেক কুমারের কথায়, ‘‘বর্তমান সরকারের উচ্চশিক্ষা নীতির মূলে রয়েছে ‘ফোর ই’। এক্সপ্যানশন, ইকুইটি, এক্সেলেন্স এবং এমপ্লয়েবিলিটি। শিক্ষার গুণমান উন্নয়ন এবং পড়ার শেষে ছেলেমেয়েরা যাতে চাকরি পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন— সেই লক্ষ্যেই চাই নতুন পাঠ্যক্রম।’’

বিকাশ ভবনের এক কর্তা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১৫ সালেই চয়েস বেসড ক্রেডি়ট সিস্টেম (সিবিসিএস) চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরে সেমেস্টার পদ্ধতি, একই ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি এবং সহজে পছন্দের বিষয় পড়ার সুবিধা চালু করার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সিবিসিএস চালু করে দিয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে সিবিসিএস চালু করার প্রধান অন্তরায়ই হল, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মধ্যে অজস্র তফাৎ। রাজ্য সরকারের দাবি, সেই বাধা দূর করতেই সিলেবাসের অভিন্ন প্রাথমিক কাঠামো তৈরির কথা ভাবা হয়েছে।

রাজ্য সরকার স্নাতকোত্তর স্তরে অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তিও শুরু করতে চায়। অথচ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সাযুজ্য না থাকলে অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু করা যাবে না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্সি-যাদবপুর-কলকাতা-উত্তরবঙ্গ বা সিদোকানহু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সিলেবাসগত ভাবে বড়সড় পার্থক্য না রাখাই সরকারের লক্ষ্য।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম তৈরির ব্যাপারে সরকার কি আদৌ হস্তক্ষেপ করতে পারে? শিক্ষাজগতের বড় অংশই কিন্তু মনে করছেন, পঠনপাঠনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই শেষ কথা। সরকার পাঠ্যক্রম তৈরি করলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে হাত দেওয়া হবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু যেমন বলছেন, ‘‘পাঠ্যক্রম তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সরকারের নয়। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম বদলাতে হলে উচ্চশিক্ষা

দফতর বড়জোর ডেকে কথা বলতে পারে। বিকাশ ভবন পাঠ্যক্রম তৈরি করলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপেরই সামিল।’’ পেশাদার কর্পোরেট উপদেষ্টা সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য উপযুক্ত কি না, সে সন্দেহও অবশ্য প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘শিক্ষা তো শিল্প নয়, যে ট্রানজাকশন অ্যাডভাইসর দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে! এটা অবাস্তব!’’

উচ্চশিক্ষা দফতরের কর্তারা এর জবাবে দাবি করছেন, তাঁরা কোনও পাঠ্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে চাপিয়ে দেবেন না। শেষ সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই নেবে। উপদেষ্টা সংস্থা, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি এবং উচ্চ শিক্ষা সংসদ এই তিনটি স্তরে নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে। তার পর চূড়ান্ত খসড়াটি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ফের আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া হবে। শেষ ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেমন চাইবে সে ভাবেই এর বাস্তবায়ন করবে। ঘটনা হল, রাজ্যের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন দশকেও পাঠ্যক্রম বদলায়নি। সরকারের বক্তব্য, তাতে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় রাজ্যের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে।

কিন্তু পাঠ্যক্রম বদলানোর কাজে শিক্ষাবিদদের সামিল না-করে কর্পোরেট উপদেষ্টা সংস্থাকে ডাকা হচ্ছে কেন? সরকারের বক্তব্য, পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত করবেন শিক্ষাবিদরাই। কিন্তু তাঁদের পক্ষে দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কী পড়াচ্ছে, কেন পড়াচ্ছে— সেই তথ্য জোগাড় করে দ্রুত পাঠ্যক্রম তৈরি করা কঠিন। উপদেষ্টা সংস্থা সেই কাজটাই করে দেবে। কী পড়লে চাকরির বাজারে কদর হবে, কী পড়লে গবেষণার পথে যাওয়া যাবে, সেটা বলে দেবে তারা। আইআইএম কলকাতার শিক্ষক অনুপ সিংহ কিন্তু এ ভাবে উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাচ্ছেন। যদিও শেষ কথা বলার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকা উচিত বলে তিনিও মনে করেন। তাঁর কথায়, ‘‘পাঠ্যক্রম তৈরির ব্যাপারে গবেষণা ও তথ্য জোগাড়ের কাজ পেশাদার সংস্থা করলে ভাল কথা। গন্ধমাদন থেকে বিশল্যকরণী ওরা খুঁজে দিলে ক্ষতি কী? তবে পাঠ্যক্রম তৈরির শেষ অধিকারটুকু বিশ্ববিদ্যালয়েরই থাকা উচিত।’’

পঠনপাঠনের মান উন্নয়নের জন্য উপদেষ্টা সংস্থার পরামর্শ নেওয়াতে আপত্তির কিছু দেখছেন না প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিঙ্গুইশড প্রফেসর স্বপন চক্রবর্তীও। কিন্তু রাজ্য সরকার যে ভাবে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধাঁচের সিলেবাস চালু করতে চাইছে, স্বপনবাবু-সহ শিক্ষাজগতের অনেকেই তার সঙ্গে সহমত নন। স্বপনবাবু স্পষ্ট বলছেন, ‘‘রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রকম পাঠ্যক্রম পড়ানোর দরকার নেই। তা সম্ভবও নয়।’’ দিল্লির অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়ক মুখ্য উপদেষ্টা মালবিকা সরকারের মতেও, ‘‘প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএনএ আলাদা। কোনও একটি মডেল সর্বত্র অনুসরণ করা বাস্তবোচিত নয়।’’

উচ্চশিক্ষা দফতর যদিও মনে করছে, সারা রাজ্যে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নীত করাই সরকারের লক্ষ্য। তার জন্যই এক ধাঁচের সিলেবাস। এই মুহূর্তে যে উপাচার্যরা রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় রয়েছেন, তাঁরা অবশ্য এ নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

partha chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE