Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নিমেষে ছিটকে গেলেন স্বামী, দুই সন্তান

কয়েক ঘণ্টা আগে মেলায় কেনা খেলনাটা এতই প্রিয় হয়ে গিয়েছিল, ভুটভুটিতে ওঠার সময়েও মায়ের হাতে দিতে চায়নি একরত্তি আকাশ। ভুটভুটি ভেঙে পড়ার সময় সেই খেলনাও ছেড়ে দিয়ে মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরেছিল সে। কিন্তু মা নিজেও তো তখন হাবুডুবু খাচ্ছেন!

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনিতা বিশ্বাস (বাঁ দিকে)। পারিবারিক অ্যালবামের ছবিতে স্বামী রামপ্রসাদ বিশ্বাস ও দুই সন্তান আকাশ-বৃষ্টির সঙ্গে অনিতা। — নিজস্ব চিত্র

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনিতা বিশ্বাস (বাঁ দিকে)। পারিবারিক অ্যালবামের ছবিতে স্বামী রামপ্রসাদ বিশ্বাস ও দুই সন্তান আকাশ-বৃষ্টির সঙ্গে অনিতা। — নিজস্ব চিত্র

সামসুদ্দিন বিশ্বাস
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

কয়েক ঘণ্টা আগে মেলায় কেনা খেলনাটা এতই প্রিয় হয়ে গিয়েছিল, ভুটভুটিতে ওঠার সময়েও মায়ের হাতে দিতে চায়নি একরত্তি আকাশ। ভুটভুটি ভেঙে পড়ার সময় সেই খেলনাও ছেড়ে দিয়ে মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরেছিল সে। কিন্তু মা নিজেও তো তখন হাবুডুবু খাচ্ছেন! একটা ঝটকায় হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেল আকাশ।

বারবার একটা কথাই বলছিলেন, বছর সাতাশের অনিতা। ঘরময় ছড়ানো ছেলের খেলনা, মেয়ের আঁকার খাতা। কিন্তু তাঁর আকাশই যে হারিয়ে গিয়েছে! শুধু আকাশ কেন, তার বড় আদরের বৃষ্টি-ই বা কোথায়? বাবার হাত শক্ত করে ধরে ছিল সে। বাবাকেও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শনিবার রাতে এক লহমায় তছনছ হয়ে দিয়েছে শান্তিপুরের অনিতা বিশ্বাসের জীবন। কালনার খেয়াঘাটে ওই রাতে অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে ভাগীরথীতে যে ভুটভুটি ভেঙে পড়েছে , তাতে নিখোঁজের তালিকায় সাত বছরের মেয়ে বৃষ্টি এবং সাড়ে তিন বছরের ছেলে আকাশ ওরফে শৌভিকের পাশাপাশি রয়েছে অনিতাদেবীর স্বামী রামপ্রসাদ বিশ্বাসের নামও।

সেই থেকে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি অনিতা। শান্তিপুরের গোপপাড়া লেনের বাড়িতে বসে রবিবার খালি এই কথাই বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘ডুবে যাওয়ার পরও তো আমরা একে অন্যকে ধরে ছিলাম। কিন্তু ওদের তো বাঁচাতে পারলাম না!’’

শনিবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ভবা পাগলার মেলা দেখতে সপরিবার কালনা যান তাঁতের যন্ত্রাংশের ব্যবসায়ী রামপ্রসাদবাবু। অনিতাদেবী জানান, মেলা থেকে ফিরতে তাঁদের কিছুটা দেরিই হয়ে গিয়েছিল। কালনা ঘাটে ফিরে দেখেন, চরম অব্যবস্থা। কোনও আলো নেই। ঝড়-বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অনেক ক্ষণ ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি ভুটভুটি ঘাটে ভেড়ে। তখনও সেই ভুটভুটিতে ওঠার যাত্রী তেমন ছিল না। কিন্তু ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় তখন ভিড় বেড়েই চলেছে।

তাঁরা চার জন ভুটভুটির এক ধারে বসেছিলেন। রামপ্রসাদ ধরেছিলেন বৃষ্টির হাত। আকাশ ছিল মায়ের সঙ্গে। তার অন্য হাতে ধরা ছিল মেলা থেকে কেনা খেলনা। হঠাৎই একসঙ্গে অনেকে উঠে পড়েন ভুটভুটিতে।

তার পরেই...

ওই দ়ৃশ্যের কথা বলতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন অনিতা। কেউ জোর করেনি, বলার তাড়াও কিছু নেই। বরং বাড়ির লোকেরা চাইছেন এবার একটু বিশ্রাম নিক মেয়েটা। কিন্তু ছেলে-মেয়ের কথা মনে পড়তে তিনি নিজেই শুরু করছেন, ‘‘আমার এই হাতটা চেপে ধরেছিল আকাশ। তবুও তো পারলাম না ওকে ধরে রাখতে। কেমন মা আমি? ওদের কাউকেই তো ধরে রাখতে পারলাম না।’’

অনিতা জানাচ্ছেন, একসঙ্গে প্রচুর যাত্রী হুড়মুড় করে ভুটভুটিতে উঠে পড়ার পর সেটি এক দিকে কাত হয়ে যায়। জল ঢুকে উল্টে যায় ভুটভুটি। তলিয়ে যাওয়ার সময় রামপ্রসাদ সবাইকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। জলে ডুবে যাওয়ার পরও কিছু ক্ষণ তারা পরস্পরের হাত ধরে ছিলেন। অনিতা সাঁতার জানতেন। সাঁতার জানতেন রামপ্রসাদও। কিন্তু, রামপ্রসাদকে অনেকে ধরেছিলেন। তার মধ্যেই একটা ঝটকায় তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

জলে ভাসতেই এক জন কেউ তাঁকে ধরে নৌকায় তুলে নেন। পাড়ে ফিরে এক জনের মোবাইল থেকে বাড়িতে শ্বশুর অনিল বিশ্বাসকে খবর দেন অনিতা। তাঁরা কালনায় এসে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান অনিতাকে। অনিতার এখন একটাই প্রশ্ন, ‘‘ওরা ফিরবে তো?’’

নৃসিংহপুরের হাউস সাইড কলোনির নীলিমা বিশ্বাস মেয়ে স্বাতীকে নিয়ে ওই মেলায় গিয়েছিলেন। ভুটভুটি উল্টোনোর সময়ও তিনি নবম শ্রেণির স্বাতীর হাত ধরেছিলেন। কিছু দূর ভেসে যাওয়ার পর মেয়ের হাত ছেড়ে যায়। ভেসে যাওয়া একটি বাঁশের মাচা ধরে কোনও রকমে বেঁচে যান তিনি। ঠাকুমা রেণুকা হালদারের সঙ্গে মেলায় গিয়েছিল নাতি সনাতন ও নাতনি রিনা। রেনুকাদেবী ও সনাতন বেঁচে ফিরলেও খোঁজ মেলেনি রিনার।

মাত্র এক রাতের ঝ়়ড়-বৃষ্টিতে ভেঙেচুরে গিয়েছে শান্তিপুরের অনেকগুলো পরিবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

accident drown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE