Advertisement
০৭ মে ২০২৪

আমি চোর নই, সিবিআই-কে পাল্টা আক্রমণের পথে মদন

সারদা-কাণ্ডে তাঁকে জেরা করার সম্ভাবনা যখন প্রবল হচ্ছে, তখন সিবিআইকেই পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। শনিবার তিনি বলেন, “আমাকে সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে লাভ নেই। আমি চোর নই।” সুদীপ্ত সেনের সংস্থা সারদার তোলা কয়েক হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। তদন্ত যত এগোচ্ছে, তত শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদদের নাম উঠে আসছে।

নিজের দফতরে ব্যস্ত পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। —নিজস্ব চিত্র

নিজের দফতরে ব্যস্ত পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৭
Share: Save:

সারদা-কাণ্ডে তাঁকে জেরা করার সম্ভাবনা যখন প্রবল হচ্ছে, তখন সিবিআইকেই পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। শনিবার তিনি বলেন, “আমাকে সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে লাভ নেই। আমি চোর নই।”

সুদীপ্ত সেনের সংস্থা সারদার তোলা কয়েক হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। তদন্ত যত এগোচ্ছে, তত শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদদের নাম উঠে আসছে। এই তালিকায় রয়েছেন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রীও। সম্প্রতি মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক রেজাউল করিম ওরফে বাপির মোমিনপুরের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। বেশ কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করার পর বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাপিকে নিজেদের দফতরে এনে জেরা করেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বাপিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সারদার সঙ্গে মদন মিত্রের সম্পর্কের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য তাঁদের হাতে এসেছে। তার ভিত্তিতেই মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান তাঁরা। শনিবার সিবিআই সূত্রের খবর, মদনবাবুকে জেরা করার ব্যাপারে প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তদন্তকারীরা। তবে তার আগে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী এবং আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই।

সিবিআই-জেরার জল্পনাকে তিনি যে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তা বোঝাতে এ দিন মুখ খোলেন মদনবাবু। গত কয়েক দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর শুক্রবারই বাড়ি গিয়েছেন তিনি। ‘আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায়’ এই আপ্তবাক্য মাথায় রেখে শনিবার তিনি বলেন, “আমি এখনও অসুস্থ। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক চলছে। ডাক্তাররা আমাকে আরও কিছু দিন হাসপাতালে থেকে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি চোর নাকি যে সিবিআইয়ের ভয়ে হাসপাতালে থাকব?” পরিবহণ মন্ত্রীর বক্তব্য, “গুজব ছড়ানো হচ্ছে আমি নাকি সিবিআইয়ের ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আমার প্রশ্ন, সিবিআই কি হাসপাতালে গিয়ে জেরা করতে পারে না? পেটে অসহ্য ব্যাথা নিয়েও বাড়িতে চলে এসেছি। দেখি সিবিআই কী বলে!” তবে সিবিআই তাঁকে জেরা করতে চাইলে তিনি দলের সঙ্গে কথা বলেই যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন, তা-ও জানাতে ভোলেলনি মদনবাবু।

সারদার সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে মদনবাবু কখনও সিবিআইকে ‘ক্রিটিক্যাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ বলেছেন, কখনও বলেছেন ‘ক্রিয়েটিভ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’। বাংলার রাজনীতির ময়দানে নিজেকে কার্যত উত্তমকুমারের সঙ্গে তুলনা করেছেন মদন। কখনও আবার গাঁধীর সঙ্গে নিজের দর্শনের তুলনা টেনেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “চুরি যখন করিনি তখন কাউকেই ভয় পাই না। এখন অবশ্য কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি দল বেঁধে মদন মিত্রের পিছনে লেগেছে। তাতে কোনও লাভ হবে না।”

কিন্তু সারদা-কাণ্ডে কেন বার বার তাঁর নাম উঠে আসছে? জবাবে পরিবহণ মন্ত্রীর দাবি, “সিবিআই ভুল পথে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি লাল পাঞ্জাবি পরলাম না হলুদ, তা নিয়ে তো তদন্ত হতে পারে না। সন্ধ্যে বেলা কোন বান্ধবীকে নিয়ে কোন ক্লাবে গেলাম, সেটাও সিবিআই তদন্তের বিষয়বস্তু হতে পারে না।” কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের গতিমুখ কী হওয়া উচিত, তা-ও বাতলে দেন মদন। বলেন, “সারদার ২৬০০ কোটি টাকা কে খেয়ে গেল, শেষে যে ১২০০ কোটি টাকা পড়ে ছিল, সেটাই বা কোথায় গেল, তা খুঁজে বের করুক সিবিআই।” আসল লোকেদের না ধরে সিবিআই ভুল পথে হাঁটছে, এই প্রশ্নের জবাবে মদনবাবু বলেন, “আগরওয়াল-মাগরওয়াল যারা ধরা পড়েছে, সাহস থাকলে তাদের মদতদাতাদের গায়ে হাত দিক সিবিআই। হিম্মত থাকলে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়কে ধরুক ওরা।” তাঁর প্রশ্ন, “যাদের হাত ধরে সুদীপ্ত সেন জন্মাল, সেই চক্রবর্তী-ভট্টাচার্য-দেব-বসুদের তো সিবিআই ডাকছে না! তা হলে কীসের তদন্ত?”

সিবিআই অবশ্য মনে করে, তাঁদের তদন্ত ঠিক পথেই এগোচ্ছে। এ দিন একাধিক তদন্তকারীর বক্তব্য, মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করার আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ আরও কয়েক জনকে জেরা করা হতে পারে। তাতে আরও কিছু তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “আরও কয়েকটা কান আমরা টানব। তার পরে জোরালো তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই মাথায় হাত দেওয়া হবে।” তদন্তকারীরা জানান, সারদা কেলেঙ্কারিতে ইতিমধ্যেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উঠে এসেছে ময়দানের আরও কয়েক জন ক্লাবকর্তার নাম। বস্তুত, মদন মিত্র রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রীও। সেই সূত্রে তাঁর এবং বাপির সঙ্গে ময়দানের কয়েক জন কর্তাব্যক্তির ঘনিষ্ঠতাও গোয়েন্দারা জেনেছেন। ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবে সারদার টাকা ঢালার পিছনে বাপি বা মদনবাবু জড়িত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে সিবিআই।

সিবিআই সূত্রের খবর, পরিবহণ মন্ত্রীর পাশাপাশি আরও কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সারদা কেলেঙ্কারিতে আর এক কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তাঁদেরও ডাকা হবে। সারদা কেলেঙ্কারিতে ইডি টাকা পাচারের তদন্ত করছে। আর এই ঘটনায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত করছে সিবিআই। কাজেই দু’ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠেরা একই ব্যক্তি। সেই কারণেই ইডি-র তদন্তে উঠে আসা নামের তালিকা হাতে নিয়েছেন সিবিআই অফিসারেরা। এই তালিকায় তৃণমূলের এক অভিনেতা-সাংসদের নামও রয়েছে বলে খবর।

তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, একটি বাংলা সিনেমায় বকলমে টাকা ঢেলেছিল সারদা। বিদেশে সেই সিনেমার প্রিমিয়ারও হয়েছিল। তাতেও সারদার জড়িত থাকার কথা উঠে এসেছে। সাধারণ মানের একটি সিনেমার প্রচারে বিদেশে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল কেন, সে প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা হচ্ছে। এর সঙ্গে ইতিমধ্যে ধৃত দু’জনের জড়িত থাকার কথা জানা গিয়েছে।

এ দিনও রাজেশ বজাজ নামে এক ব্যবসায়ী এবং অসমের গায়ক-চিত্র পরিচালক সদানন্দ গগৈকে জেরা করেন তদন্তকারীরা। রাজেশ বজাজের ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে সারদার পর্যটন ব্যবসার যোগাযোগ ছিল বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। তৃণমূলের বহিষ্কৃত রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষের একটি পাক্ষিক খবরের কাগজ নিয়েও খোঁজখবর করছেন তদন্তকারীরা। সেই কাগজের সঙ্গে তৃণমূলের অন্য এক সাংসদেরও যোগাযোগ ছিল বলে খবর।

সারদা-কাণ্ডের তদন্ত নিয়ে এ দিন ফের তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “অমিত শাহকে তো সিবিআই হেফাজতে নিয়েছিল। চার্জশিটও দিয়েছিল। তার পরেও তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীকে ১৯ ঘণ্টা জেরা করার পরেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সিবিআই যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই কাজ করে, এ সব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।” এর পাল্টা বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কাজ করছে। আমরা চাই সব দোষীর শাস্তি হোক। একটা দলের ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত সবাই দুর্নীতিতে জড়িত, এমন নজির সহজে মেলে না। তৃণমূল সেই নজির গড়েছে।” শুক্রবার ‘উত্তরকন্যা’ অভিযানে শিলিগুড়িতে এসে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী সারদা নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিঁধলেও এ দিন এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক সি পি যোশী বলেন, “সিবিআই সারদা তদন্তে চার্জশিট জমা দিলেই বোঝা যাবে কে বা কারা দোষী। তার আগে মন্তব্য করা উচিত নয়।” এই নিয়ে অধীরবাবুর প্রতিক্রিয়া, “যোশীজি দিল্লিতে থাকেন। আমরা রাজ্যে থাকি। সারদা-কাণ্ডে কী ভাবে, কাদের মদতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতারিত হয়েছেন তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। সে জন্যই আমরা তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের একাংশের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছি।” কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছেন, “দিদি (মমতা) কি জানতেন না, তাঁর সহকর্মীরা সারদার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন?”

ডুয়ার্সে সারদা গোষ্ঠীর রিসর্ট নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল ইডি। এ দিন ইডি-র পক্ষ থেকে সারদার রিসর্টে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়।

ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি পর্যায়ে উত্তরবঙ্গে তদন্তে নেমে শিলিগুড়ির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল কার মাধ্যমে কত টাকায় সারদা গোষ্ঠী কিনেছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হয়েছে। শিলিগুড়ি শহরের কড়াইবাড়ি এলাকার ওই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি ৫ কোটি টাকায় সারদা সংস্থা কিনেছিল বলে প্রাথমিক ভাবে খবর পেয়েছে ইডি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam cbi madan mitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE