Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা...

একাধিকবার উত্তরবঙ্গে এসেছেন কিশোর কুমার। এখনও অগণিত ভক্ত তাঁর। সাত জেলায় শতাধিক শিল্পী ‘কিশোর-কণ্ঠী’ হিসেবেই এলাকার গানের দুনিয়ায় জায়গা করেছেন। কেউ কলকাতা, মুম্বইয়ে গিয়ে ব্যান্ডে সুযোগ পেয়েছেন। আজ, কিশোর কুমারের জন্মদিনে এমনই কয়েকজনের কথা তুলে ধরল আনন্দবাজার। আশির দশকের কথা। কিশোর কুমার এসেছিলেন কোচবিহারে। রাজবাড়ি ময়দানে বসেছিল জলসা। সেই মঞ্চেই কিশোর কুমারের গান সরাসরি উপভোগের প্রথম সুযোগ হয়েছিল জেলার বাসিন্দাদের অনেকের।

আশির দশকে শিলিগুড়িতে একটি অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কিশোর কুমার।

আশির দশকে শিলিগুড়িতে একটি অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কিশোর কুমার।

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৮
Share: Save:

লুকোচুরি, লুচি-কচুরি

আশির দশকের কথা। কিশোর কুমার এসেছিলেন কোচবিহারে। রাজবাড়ি ময়দানে বসেছিল জলসা। সেই মঞ্চেই কিশোর কুমারের গান সরাসরি উপভোগের প্রথম সুযোগ হয়েছিল জেলার বাসিন্দাদের অনেকের। সেটাই শেষবারও। ভিড়ে ঠাসা ওই অনুষ্ঠানের দর্শকের মধ্যে ছিলেন বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তাঁর মনে পড়ছে, “একশো টাকার টিকিট কেটে কিশোর কুমারের ওই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। এখনও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে শিহরিত লাগে।” কোচবিহারের বাসিন্দা এনবিএসটিসির পরিচালন বোর্ডের সদস্য আবদুল জলিল আহমেদ কলি আউরান, জিন্দেগি সফর হ্যায় গানটা এখনও কানে লেগে আছে। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা তরুণ দাস জানিয়েছেন, মজা করে ওই অনুষ্ঠানে লুকোচুরি ছবিকে প্রথমে লুচি-কচুরি বলে ছিলেন গায়ক। মনে পড়লেই নস্টালজিক লাগে। উদ্যোক্তাদের স্মৃতিতেও অনুষ্ঠানের স্মৃতি টাটকা। তাদের একজন শ্রীচাঁদ জৈন বললেন, “উনি অনুষ্ঠানের আগের দিন বিমানে এসেছিলেন। সার্কিট হাউসে ছিলেন।”

গুরুর জন্মদিনে জলসা

বালুরঘাটের খাদিমপুর এলাকার শিল্পী গৌতম মজুমদার একটা সময় মান্না দের গান গাইতেন। পরে দেখেন, জলসার শুরুতে হারমোনিয়াম ডুগি তবলায় বৈঠকি গানের চেয়ে কিশোরের গান গেয়ে দর্শকদের বেশি মনোরঞ্জন দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। শুরু করেন গৌতম কিশোর কুমারের গান। আর দেখতে হয়নি তাকে। জলসা মাত করে রুজির টানে গৌতম এখনও কিশোরের গান গাইছেন। কিশোরের গানকে অনুকরণ করে পাড়ার জলসায় গেয়ে দর্শকদের মন কাড়েন রাজীব ভট্টাচার্য। রাজীবের পর নতুন প্রজন্মের শিল্পী অমরও কিশোর কুমারের ভক্ত। কিশোরের গান অন্তপ্রাণ, কিশোরভক্ত ছিলেন শহরের এক নম্বর নাগরিক বালুরঘাট পুরসভার চেয়ারপার্সন প্রয়াত চয়নিকা লাহা। প্রতি বছর সন্ধ্যায় ‘গুরু’ কিশোর কুমারের জন্মদিনে কিশোরকণ্ঠীদের দিয়ে জলসার আসর বসিয়ে সকলকে নিয়ে মেতে উঠতেন।

মালদহে ফ্যান ক্লাব

মালদহে কখনও আসেননি সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমার। তবে তাঁর নাম অনুসারে মালদহে রয়েছে কিশোর ফ্যান ক্লাব। ২০০৭ সালে জনা ২৫ সঙ্গীত শিল্পী মিলে এই ফ্যান ক্লাব গড়ে তুলেছেন। ক্লাবের সম্পাদক সন্তোষ পাইন নিজেও কিশোর-কণ্ঠী শিল্পী। কিশোর কুমারের গান করেই সংসার চালান পুরাতন মালদহের ঘোষপাড়ার বাসিন্দা সুরজিৎ পাইন। তিনি বলেন, ‘‘২২ বছর ধরে সিং নেই তবু নাম তার সিংহ, আশা ভালো বাসা এবং ডন সিনেমার খাইকে পান বানারস বালা গান গেয়েই চলেছি।’’ ২৫ বছর ধরে কিশোর কুমারে কণ্ঠে গাইছেন ইংরেজবাজার শহরের বাসিন্দা মৃণাল চক্রবতী ওরফে রামও।

উত্তরের কণ্ঠী দক্ষিণেও

উত্তরের কিশোর কণ্ঠী ডাক পান দক্ষিণবঙ্গেও। গত বছর ৪ অগস্ট দুর্গাপুরের সৃজনী হলে কিশোর কুমার ফ্যান ক্লাবের উদ্যোগে গিয়েছিলেন কোচবিহারের মারুগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক সুজিত রায়। সেখানে দুটি গান পরিবেশন করে প্রশংসাও কুড়োন। সুজিতবাবুর তুলনায় বয়সে ছোট তরুণ শিল্পী সুরঞ্জিত পুরকায়স্থ। তিনিও কিশোর কুমারের গান করেন। আরও নবীন প্রজন্মের এক শ্রোতা ঐশী সাহা বলেন, “লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রাবণী সেন, ইন্দ্রানী সেন থেকে অরিজিৎ সিংহ অনেকের গানই মাঝেমধ্যে শুনি। ভাল লাগে। তবে রোজ নিয়ম করে কিশোর কুমারের অন্তত একটা গান শোনা আমার রুটিন। কেউই যে ওঁর ধারেকাছে নেই।” এত তো রোমান্টিক স্যাড সং রয়েছে কিন্তু ‘দিল অ্যায়সা কিসিনে মেরা তোড়া’ তবু কেন সবার মুখে মুখে ফেরে?, পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন কলেজ পড়ুয়া লক্ষ্মী দাস।

বড়বাবুর উ-রু-রু-রু

প্রতিদিন কিশোর কুমারের সুর না ভাঁজলে যেন ভাতই হজম হয় না রাঙামাটি চা বাগানের বড়বাবু শ্যামল বসুর। ষাট ছুঁতে চলা শ্যামলবাবু প্রচার বিমুখ হলেও ডুয়ার্সের অনেক শ্রোতাই কিশোরকণ্ঠী হিসেবেই তাঁকে চেনেন। মালবাজারের বাসিন্দা দিলীপ দত্ত এবং কাজল সেনগুপ্ত দুই বন্ধু আজও আড্ডার ফাঁকে ফাঁকেই কিশোরের গলায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। মালবাজারের আরেক প্রবীণ শিল্পী কাজল ঘটকের কিশোরের গলায় মঞ্চকাঁপানো গান আজও ডুয়ার্সের অনেক শ্রোতাদেরই মুখে মুখে ঘোরে। এখনকার ছেলে মেয়েরা, যারা মোবাইলে গান শুনতে অভ্যস্ত ওরা কিশোরকে মনে রাখবে তো, এই ভেবে একটু চিন্তায় পড়ে যান মালবাজারের সঙ্গীতশিল্পী কাজল সেনগুপ্ত। তবে ওঁদের চিন্তা অনেকটাই দূর করেছে সদ্য ত্রিশ পেরোনো যুবক বিশ্বজিৎ সরকার, অশোক জায়সবালেরা। শিক্ষাকর্মী বিশ্বজিৎ এবং হোটেল ব্যবসায়ী অশোক প্রায় দিনই বাড়িতে কিশোরের গানের রেওয়াজ করে চলেছেন।

রবীন্দ্র-স্মরণেও কিশোর

তিনমাস আগে কালিয়াগঞ্জে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম। সেখানেও শ্রোতারা কিশোরকুমারের গান গাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। বললেন রায়গঞ্জের প্রবীণ শিল্পী আশিস চৌধুরী। আলিপুরদুয়ারে নিউটাউন বাজার এলাকার কিশোরকণ্ঠী দেবব্রত রায় গত ১৪ বছর ধরে গান করছেন। এখন কোলকাতার তিনটি ব্যান্ডে সঙ্গে গান করেন দেবু। তিনি বলেন, ‘‘আগে মঞ্চে উঠে একের পর এক শুধু কিশোর কুমারের গান গাইতাম। এখন সে সুযোগ পাইনা। ভেতরে কষ্ট হলেও জীবিকার টানে শ্রোতাদের চাহিদা পূরন করতে হয়।’’ দেবুবাবুর মা মীনা রায় জানালেন ছেলের গায়ক হওয়ার গল্প। আলিপুরদুয়ার মিউনিসিপ্যালিটি হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। ওকে নিয়ে গান শুনতে গিয়েছি। হঠাৎই ছেলে গান গাওয়ার বায়না ধরলো। তখনও ছেলের প্রথাগত গান শেখা শুরু হয়নি। ওর বায়না শুনে উদ্যোক্তারা গান গাওয়ার সুযোগ দিলেন। মঞ্চ উঠে ১৩ বছরের দেবু কিশোর কুমারের একটি গান গাইতেই হাততালি। এর পরে ওর বাবা দেবুকে গান শেখাতে শুরু করলেন।

কিশোর, লতাও

একবার নয়, শিলিগুড়িতে একাধিকবার এসেছেন কিশোরকুমার। শহরের বিবেকানন্দ ক্লাবের উদ্যোগেও এসেছিলেন তিনি। প্রবীণ কর্মকর্তা প্রদীপ দত্ত, মলয় চক্রবর্তীদের কথায়, কিশোর কুমার প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছেন বর্তমানে তিলক রোড়ের মিত্র নার্সিংহোমের যে জায়গা সেখানে। তখন সেটি ফাঁকা মাঠ ছিল। শহরের সেই সেই স্মৃতি আজও ভোলার নয়। শিলিগুড়িতে এখন যে সব বড় হোটেল তার একটিও ছিল না। পরের বার অনুষ্ঠান হয়েছিল তিলক ময়দান বর্তমানে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের মাঠে। শেষ এসেছিলেন ১৯৮৫ সালে। সব চেয়ে জৌলুস ছিল ওই অনুষ্ঠানে। কিশোরকুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর। শিলিগুড়ি হিন্দি হাই স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রচুর লোক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা তথা সঙ্গীতশিল্পী স্বপন দে বলেন, ‘‘পুজোর সময় কিশোর কুমারের নতুন গানের ক্যাসেট জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সঙ্গে বার হত গানের চটি বই। তাতে স্বরলিপি দেওয়া থাকত।’’

এবং মহাদেব

“খাইকে পান বানারসওয়ালা” থেকে “আরে দিওয়ানো, মুঝে পহচানো”— ডন ছবির গানে দর্শক আনন্দে মাতোয়ারা। এক সময় বালুরঘাট শহর থেকে জেলা জুড়ে প্রতি জলসায় কিশোরের গান গেয়ে মাত করে দেওয়া কিশোরকণ্ঠী শিল্পী বলতে প্রথমেই বালুরঘাটের মহাদেবের নাম শোনা যেত। কিশোরের গান আর মহাদেব যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। মহাদেব আজও কিশোরের গানে সমান সাবলীল। সংবাদমাধ্যম ও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেও গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kishore kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE