Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আত্মবিশ্বাসের জাদুকাঠি পুজোর অন্য বাজার

প্রস্থেসিস বা কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্মাতা সুমিত্রা অগ্রবালের কথায়, ‘‘এমনিতে মাসে ২-৩ জন ক্যানসার রোগী উইগ নেন।



চাহিদায় এই ধরনের নকল চুল ও স্তন।

চাহিদায় এই ধরনের নকল চুল ও স্তন।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৩৫
Share: Save:

এও এক পুজোর বাজার। তবে একটু অন্য রকম।

ক্যানসার-আক্রান্তরা, বিশেষত মহিলারা অনেকেই ইদানীং কৃত্রিম স্তন এবং পরচুলা কেনার জন্য বেছে নিচ্ছেন উৎসবের মুহূর্তকেই। প্রতি বছর তাই উৎসবের মরসুমে ক্যানসার রোগীদের জন্য তৈরি সিলিকন ব্রেস্ট এবং‌ উইগের বিক্রি বেড়ে যাচ্ছে।

প্রস্থেসিস বা কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্মাতা সুমিত্রা অগ্রবালের কথায়, ‘‘এমনিতে মাসে ২-৩ জন ক্যানসার রোগী উইগ নেন। কিন্তু পুজো-নবরাত্রি-দীপাবলির মুখে মাসে ১১ জন রোগী উইগ কিনেছেন। দামি সিলিকন ব্রেস্ট সাধারণত মাসে ১-২ জন নেন। এ বার উৎসবের মাসে সেটা দাঁড়িয়েছে ৬ জনে।’’

বিভিন্ন হাসপাতালের ক্যানসার রোগীদের জন্য বিদেশি প্রস্থেটিক ব্রেস্ট সরবরাহ করেন বর্ণালি সরকার। তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘উৎসবে অনেক ক্যানসার রোগী পুরনো প্রস্থেটিক ব্রেস্ট বদল করে নতুনও কেনেন।’’ বালি-র বাসিন্দা বছর ছাব্বিশের অভিদীপ্তা চট্টরাজ যেমন জানালেন, গত বছর মে মাস নাগাদ ম্যাসটেকটমি করে তাঁর বাঁ দিকের স্তন বাদ যায়। তার পর সাধারণ মানের একটি প্রস্থেসিস ব্যবহার করছিলেন। তাতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ঠিক করেছিলেন, পুজো-বোনাস পেয়েই সিলিকন প্রস্থেটিক ব্রেস্ট কিনবেন। সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে সেটাই কিনেছেন।

একই অভিজ্ঞতা উইগের ক্ষেত্রেও। ক্যানসার রোগীদের উইগ সরবরাহকারী কাঁকুড়গাছির একটি সংস্থার কর্ণধার প্রদীপ বসাক বলছেন, ‘‘এমনি সময় মাসে ৭০-৮০টা উইগ বিক্রি হয়। উৎসবের মাসে সেটা ১০০-১৫০-এ পৌঁছয়।’’ খোঁপা, লম্বা চুল এবং হাল্কা বেজ বা ব্রাউন রঙ করা উইগের বিক্রি এই সময় বেশি হয়। ক্যানসার রোগী শরন্যা গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এমনিতে আমার উইগটা বয় কাটের। পুজোয় শাড়ি পরব বলে একটা লম্বা বিনুনি-র উইগ কিনেছি।’’

উৎসবের আবহে এ ভাবেই কৃত্রিম চুল ও স্তন হয়ে উঠছে ক্যানসার-আক্রান্ত মহিলাদের আত্মবিশ্বাসের জাদুকাঠি! সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, ‘‘নারীত্বের পরিচয়বহনকারী চিহ্নগুলো রোগের দাপটে যখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাস নড়ে যায়। প্রস্থেসিসকে তাই নিছক সৌন্দর্যরক্ষার উপাদান হিসেবে ভাবা চলে না।’’

চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ও দেখেছেন, ‘‘কেমো নিয়ে একজন পুরুষের চুল উঠে গেলে তাঁকে অতটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু সেটা একটা মেয়ের হলে সকলের নজর গিয়ে পড়ে। উৎসবে তাই এঁরা ক্যানসার-প্রস্থেসিস কেনেন সেই অবসাদকে হারিয়ে দিতে।’’ শুধু পশ্চিমবঙ্গেই এখন দেড় লক্ষের মতো মহিলা ক্যানসার আক্রান্ত। ফলে রোগের পাশাপাশি তাঁদের মানসিক ও সামাজিক লড়াইকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

স্তন ক্যানসারকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা বিদিশা প্রকাশ যেমন বলছিলেন, ‘‘আনন্দ করতে বেরিয়ে আমার জন্য আমার পরিবারকে যাতে অস্বস্তিতে পড়তে না-হয় সেই জন্য উৎসবের আগে প্রস্থেটিক চুল বা স্তন কিনে লাগানোটা আমার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।’’ ঠিক এই অনুভূতিরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন অঙ্কোলজিস্ট শারদ্বত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘উৎসব মানে সামাজিক মেলামেশা, সাজগোজ, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা। এই সময় চুল উঠে যাওয়া মাথা নিয়ে বা স্তন বাদ যাওয়া অবস্থায় চেনাপরিচিতদের মাঝে গেলে রোগের প্রসঙ্গ এসে পড়বেই। যা এড়াতে প্রস্থেসিস দরকার।’’

অর্থনৈতিক দিকটাও আছে। অঙ্কোলজিস্ট সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় মনে করালেন, ‘‘মধ্যবিত্ত রোগীদের অনেকে অপেক্ষা করে থাকেন পুজোর বোনাসের জন্য। অনেকে সারা বছর ধরে রেকারিং-এ টাকা জমান পুজোর কেনাকাটার জন্য। সেই থোক টাকায় তাঁরা ক্যানসার-প্রস্থেসিসটা কেনেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE