লালবাজার পেরেছে। বিকাশ ভবন পারল না। উল্টে উঁচুতলার মর্জিতে ঘাড় নেড়ে সরকারি অফিস বা আদালতের মতো ছুটির হাওয়াই বইয়ে দিল স্কুলে–স্কুলে। ঠিক হচ্ছে না বুঝেও।
এবং এই বাজারে এ-ও যেন উলটপুরাণ!
সম্প্রতি কলকাতা পুলিশ শিরদাঁড়া খাড়া করে ভোটের সন্ত্রাসে লাগাম টেনেছে, যাতে স্বস্তির মুখ দেখেছেন ভোটাররা। তার জন্য পুলিশকর্তাদের অনেককে মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পড়তে হলেও লালবাজার পিছিয়ে আসেনি। বিধাননগর-সহ রাজ্যের আরও অনেক জায়গায় নানা পুলিশকর্তার এমন ঋজু মেরুদণ্ড দেখা গিয়েছে। স্কুলশিক্ষা-কর্তারা কিন্তু গুটিয়েই রইলেন। পাছে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী রুষ্ট হন, সেই ভয়ে স্কুলের অনাবশ্যক অবকাশে তাঁরা দাঁড়ি টানতে পারলেন না। পঠনপাঠন শিকেয় তুলে
স্কুলগুলো এক মাসের ‘প্রাক্ গ্রীষ্ম’ ছুটিতে মজে রইল।
অসময়ে অস্বাভাবিক গরমের কারণে ১১ এপ্রিল রাজ্যের ছ’হাজার স্কুলে ছুটি পড়ে গিয়েছিল। বিকাশ ভবনের এক কর্তা বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে ১১ এপ্রিল থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ছেলেমেয়েদের গরম থেকে বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেতেই ছুটি দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত ছুটি চলবে।’’
ঘটনা হল, দু’সপ্তাহ আগে দক্ষিণবঙ্গ থেকে তাপপ্রবাহ বিদায় নিয়েছে। গত দশ দিন ধরে উত্তরবঙ্গেও বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অথচ ছুটিতে ছেদ পড়েনি। বিকাশ ভবনের কর্তাদের দাবি, এত দিন ভোটের কারণে শিক্ষামন্ত্রীর নাগালই পাননি তাঁরা। তাই আবহাওয়া বদলে গিয়েছে বুঝতে পেরেও ছুটির পালা শেষ করা যায়নি।
শিক্ষা-সূত্রের অবশ্য ইঙ্গিত, মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইচ্ছে অনুযায়ী’ শিক্ষামন্ত্রী নির্দেশিত ছুটির মেয়াদ কবে শেষ হবে, তা ঘোষণার ভার কর্তারা মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রীর উপরেই ছেড়ে রেখেছিলেন। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাননি। বিকাশ ভবনের খবর: সম্প্রতি সেখানে শিক্ষা-কর্তাদের এক বৈঠকে অবিলম্বে স্কুল খোলার দাবি ওঠে। কিন্তু এক বড় কর্তা সাফ জানিয়ে দেন, শিক্ষামন্ত্রীর অনুমতি বিনা কিছু করা যাবে না। অগত্যা ছুটি ওঠেনি।
চলতি শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল, রাজ্যের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে গরমের ছুটি পড়বে ২৩ মে। টানা এক মাস এই বাড়তি ছুটির পরে ফের এক মাস গরমের ছুটি থাকলে বিশেষত নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের সিলেবাস শেষ করা মুশকিল। তাই গ্রীষ্মাবকাশ কাটছাঁটের প্রস্তাব এসেছিল। তবে শিক্ষকেরা বেঁকে বসেন। তাঁদের বক্তব্য, গত চল্লিশ দিন ক্লাস না-হলেও তাঁদের নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়েছে। তাই গরমের ছুটিতে হাত দেওয়া চলবে না। ক্লাস বন্ধ রেখে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাজিরার ফরমান কেন, সে সংশয়ও প্রকট হয়ে ওঠে।
টানাপড়েন থেকে উদ্ধার পেতে শিক্ষামন্ত্রীর একটা ফোনের অপেক্ষায় ছিল বিকাশ ভবন। বুধবার অবশেষে ফোন এসেছে। জনপ্রিয়তার মোহে কথায় কথায় ছুটি দিয়ে নাম কুড়িয়েছে যে সরকার, তার মন্ত্রী প্রত্যাশিত ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, ছুটি ছাঁটাইয়ের প্রশ্ন নেই। সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলে গরমের ছুটি পড়বে ১৯ মে। এখনকার ছুটি শেষ হচ্ছে ১৪ মে, শনিবার। মাঝে তিন দিন শুধু ক্লাস। তার পরে সেই একেবারে ১১ জুন। সেটি শনিবার। মানে, পরের দিন ফের ছুটি!
সিলেবাস শেষ হবে কী করে?
শিক্ষা দফতরের নিয়ম বলছে, স্কুলে বছরে অন্তত ২৪০টি ক্লাস নিতেই হবে। দিতে হবে ৬৫ দিন ছুটিও। উপরন্তু বছরে ৫২টি রবিবার ধরলে মোট ছুটি ১১৭ দিন। এ বছর সঙ্গে জুড়ছে ৩৪ দিনের উপরি। এতে ২৪০ দিনের বাধ্যতামূলক ক্লাসের নিয়ম মানা যাচ্ছে না। পরিণামে বিপুল সিলেবাসের চাপে পড়ুয়াদের নাজেহাল হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও প্রশাসনের বড় অংশের মতে, বর্তমান সরকারের ‘ছুটিবিলাসে’র দৌলতে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির কার্যত দফারফা হয়ে গিয়েছে। গত পাঁচ বছরে রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য নিত্য-নতুন ছুটি ঘোষণা হয়েছে। রবীন্দ্রজয়ন্তী থেকে পয়লা জানুয়ারি, জামাইষষ্ঠী থেকে শিবরাত্রি— কী নেই তালিকায়? ‘‘স্কুলপড়ুয়াদের হাতেও এ বার ছুটির তোফা তুলে দেওয়া হল।’’— কটাক্ষ এক শিক্ষাবিদের। কলকাতার এক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মন্তব্য, ‘‘অকারণে ছুটি পাওয়ার অভ্যেসটা বিপদ ডাকছে। ছাত্রেরা হরেক অছিলায় ছুটির বায়না ধরছে। শিক্ষকেরাও বাদ যাচ্ছেন না।’’ পরের বছর অতিরিক্ত গরমের জন্য সরকারি কর্মীরাও ছুটি চেয়ে বসলে আশ্চর্যের কিছু দেখছেন না এক আমলা।
বস্তুত প্রধান শিক্ষকদের অনেকেই স্বীকার করে নিচ্ছেন, বাড়তি এই এক মাসের ছুটি আখেরে পড়ুয়াদেরই বাড়তি চাপে ফেলবে। হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষার সামন্ত যেমন বলেন, ‘‘ছুটির জন্য আমাদের ক্লাসের প্রাথমিক মূল্যায়ন পরীক্ষা হয়নি। এ ভাবে এক মাস স্কুল বন্ধ থাকলে পঠনপাঠনের স্বাভাবিক গতি চলে যায়।’’ কার্যত টানা দু’মাস ছুটির পরে সিলেবাস শেষ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তুষারবাবু। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আগামী বছর থেকে মাধ্যমিকে নতুন ধাঁচের প্রশ্নপত্র। পড়ুয়াদের তৈরি করতে হবে। অথচ যথেষ্ট সময় হাতে নেই।’’
শাখাওয়াত গর্ভনমেন্টের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সিংহমহাপাত্রও একসুর। তাঁর আশঙ্কা, ছুটির জেরে পড়ুয়াদের ভোগান্তির সীমা থাকবে না। ‘‘এক দিকে শিক্ষা দফতর সিলেবাস ঢেলে সাজছে। প্রজেক্টনির্ভর পড়াশোনায় ক্লাস করা ভীষণ জরুরি। ক্লাস বন্ধ থাকলে পুরোটাই গোলমাল হয়ে যায়।’’— খেদ পাপিয়াদেবীর। রাজ্যের প্রধান শিক্ষক সমিতির তরফে নীহারেন্দু চৌধুরীর বক্তব্য: ‘‘ছুটির ব্যাপারে স্কুলশিক্ষা দফতর যে ভাবে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে রইল, তাতে আমি হতাশ।’’ তাঁর প্রশ্ন— ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু তো এমনই! ফি বছর যদি এমন গরম পড়ে, তা হলে কি প্রতি বার এমনই হবে?’’ প্রধান শিক্ষকেরা আপত্তি তুলছেন না কেন?
তুষারবাবুর জবাব, ‘‘আমরা শিক্ষা দফতরের অধীনে কাজ করি। ওদের উপরে গিয়ে কিছু করতে পারি না।’’
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য ভাবিত নন। তিনি মনে করেন না, সিলেবাস শেষ করতে কোনও অসুবিধে হবে। পার্থবাবু বরং বলছেন, ‘‘ছুটি দিয়েছি মানে বাড়িতে খেলাধুলো করতে তো বলিনি! ছুটিতে পড়াশোনাও করতে হয়। যারা পড়েছে, তাদের সমস্যা হবে না। স্কুলকেও বলা হয়েছে পড়ুয়াদের ছুটির কাজ দিতে।’’
সব মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘পড়াশোনার মধ্যেই’ রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে বলে শিক্ষামন্ত্রীর দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy