পুরভোটকে সামনে রেখে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার প্রথম ধাপে নজর দিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে নতুন নিয়োগে। সব কিছু ঠিক থাকলে ৩১ জুলাই রাজ্যের পরবর্তী নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিতে চলেছেন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। বর্তমান কমিশনার মীরা পাণ্ডে অবসর নেবেন সে দিনই। কিন্তু তার আগে সুশান্তবাবুকে তাঁর জায়গায় মনোনীত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যেমন এক দিকে প্রথা ভাঙল, তেমনই উস্কে দিল এক রাশ বিতর্ক।
বিতর্ক কেন? প্রথাই বা কী ছিল?
প্রশাসনের একাংশ বলছেন, এ যাবৎ পশ্চিমবঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র আইএএস অফিসারদের রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাথায় বসানো হয়েছে। সব রাজ্যেই এই প্রথা মেনে নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন। ব্যতিক্রম শুধু কেরল। বিচার ব্যবস্থার (জুডিশিয়াল সার্ভিস) প্রতিনিধিদের হাতেও রাজ্যের ভোট-কর্তার দায়িত্ব অর্পণের নজির রয়েছে সেখানে। নবান্নের এক মহলের বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত যাঁরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব সামলেছেন, তাঁদের কেউ চাকরি জীবনের শেষ লগ্নে মুখ্যসচিব হয়েছেন, কেউ পেয়েছেন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব বা প্রধান সচিবের পদ। কিন্তু সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় আইএএস নন। ডব্লিউবিসিএস অফিসার হিসেবে তিনি রাজভবনের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৩-য়। তার পরে দু’দফায় পুনর্নিয়োগ পেয়ে এখন সেখানেই আছেন। নবান্ন-সূত্রের খবর: সুশান্তবাবু যে ব্যাচের বিসিএস, সেই ১৯৮০-র অফিসারদের অনেকে আইএএসে পদোন্নতির সুবাদে বিশেষ সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়ে গিয়েছেন। দু’বছরের মধ্যে তাঁদের সচিব হওয়ার কথা। কিন্তু সুশান্তবাবু আইএএসে প্রোমোশন না-পাওয়ায় তাঁকে বিশেষ সচিব হিসেবেই অবসর নিতে হয়। বস্তুত রাজ্য প্রশাসনের আইএএস অফিসারদের অনেকেই মনে করছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে সুশান্তবাবুর মতো এক জন বিসিএস অফিসারকে বসিয়ে আদতে চেয়ারটির গরিমা ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। এ হেন মনোভাবের কারণ কী?
আইএএস’দের এই মহলের যুক্তি: পুর-পঞ্চায়েতের ভোটপর্ব সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে গেলে রাজ্য প্রশাসনের অফিসারদের উপরে নির্বাচন-কর্তার কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, বর্তমান কমিশনারের আমলে তা বহু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। গত বছর নির্দিষ্ট সময়ে পঞ্চায়েত ভোট আয়োজন এবং ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের মতবিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। রায় শেষে কমিশনের পক্ষেই যায়। “মীরাদেবী বিনা যুদ্ধে এক চুল জমিও ছাড়েননি। এমন সাংবিধানিক টানাপড়েনের সময়ে এক জন সিনিয়র অফিসারের পক্ষে যত সহজে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব, তুলনায় জুনিয়র অফিসার তা না-ও পারতে পারেন।” মন্তব্য রাজ্য প্রশাসনের এক প্রবীণ আইএএসের। ওঁদের মতে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদের ধার-ভারের সঙ্গে মানানসই দক্ষ অফিসারকেই ওই পদে বসানো উচিত।
উল্লেখ্য, রাজ্যে ১৭টি পুরসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার প্রশ্নে ইতিমধ্যে কমিশনের সঙ্গে সরকারের মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। তার জেরে কমিশন কোর্টেও গিয়েছে। উপরন্তু সামনের এক বছরের মধ্যে কলকাতা-সহ আরও ৭০টি পুরসভার ভোট হওয়ার কথা। এমতাবস্থায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে সুশান্তবাবুর নিয়োগের মধ্যে যথেষ্ট তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছেন প্রশাসনের কর্তাদের অনেকে। এঁদের কারও কারও ধারণা, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে মীরাদেবীর সঙ্গে যেমন প্রতি পদে সরকারের সংঘাত বেঁধেছিল, সুশান্তবাবুর সঙ্গে তেমনটা না-ও হতে পারে। এবং কমিশন সে ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে ‘আলোচনা সাপেক্ষে’ পদক্ষেপ করার কথা ভাবতে পারে। বুধবার অবশ্য রাজ্যের তরফে হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানানো হয়েছে, তারা মোট ৮৭টি পুরসভায় একসঙ্গেই নির্বাচন সারতে চায়।
কমিশনারের চেয়ারে শুধু সিনিয়র আইএএসদের বসানোর রীতি সমস্ত রাজ্য মেনে আসছে কেন, প্রশাসনের একাংশের কাছ থেকে তার আরও ব্যাখ্যা মিলছে। একাধিক অফিসারের বক্তব্য: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মূল কাজ পঞ্চায়েত ও পুরভোট পরিচালনা। তা সুষ্ঠু ভাবে করতে রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব কিংবা রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে কমিশনারের নিজের অফিসে ডেকে পাঠানোর দরকার পড়তে পারে। মীরা পাণ্ডে যেমন বিগত পঞ্চায়েত ভোটের আগে মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে একাধিক বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পদমর্যাদার নিরিখে বা চাকরিজীবনে সিনিয়র না-হলে স্বভাবতই কোনও কমিশনারের পক্ষে ওই কাজ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
আমলাদের অন্য মহল অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের পাল্টা দাবি, “কমিশনের আইনেই বলা আছে, অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত কোনও সরকারি আধিকারিককে এই পদে নিয়োগ করতে পারে রাজ্য। সেখানে কোনও পদমর্যাদা বা নির্দিষ্ট ক্যাডারের উল্লেখ নেই।” আর তাই সুশান্তবাবুকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসানোটা গর্হিত কিছু নয় বলে এঁদের অভিমত। নবান্নের অনেকের মন্তব্য, “সুশান্তবাবু খুবই দক্ষ অফিসার। নিছক ডব্লিউবিসিএস বলে উনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন না, এমন বাধ্যবাধকতা নেই।” সুশান্তবাবুরও প্রশ্ন, “ভোট পরিচালনা করতে গিয়ে যদি প্রয়োজন পড়ে, তা হলে সরকারি কর্তাদের তলব করতেই হবে! অসুবিধে কোথায়?” রাজ্যের ভাবী নির্বাচন কমিশনার বুধবার বলেন, “আইনেই কমিশনারের ক্ষমতা ও কাজের এক্তিয়ার বেঁধে দেওয়া আছে। সেই মতো সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা আমার প্রধান কাজ।”
২০০১ ইস্তক সুশান্তবাবু রাজভবনে। এক সময়ে বোলপুর ও খাতড়ার মহকুমাশাসক ছিলেন। ১৩ বছর আগে, রাজ্যপাল বীরেন জে শাহের আমলে তিনি উপ-সচিবের দায়িত্ব নিয়ে রাজভবনে আসেন। পরে গোপালকৃষ্ণ গাঁধী এবং এম কে নারায়ণনের কাছেও কাজ করেছেন। সেখানেই ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৩-য় রাজ্যপালের বিশেষ সচিব হন, এবং সে বছরেই অবসর নেন। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: মাঠে-ঘাটে নেমে প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতা সুশান্তবাবুর তুলনায় কম। নিদেনপক্ষে একটা দফতর পরিচালনারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। এমন অফিসারকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে সরকার আদতে কমিশনকেই দুর্বল করতে চাইছে বলে মনে করছে কেউ কেউ।
কমিশনারের পাশাপাশি কমিশনে নতুন সচিবও আনল রাজ্য সরকার। এ দিন ওই পদে বসেছেন পূর্ত দফতরের যুগ্ম সচিব ওসমান গনি। কমিশনের প্রাক্তন সচিব তাপস রায় গত মার্চে অবসর নেওয়ার পরে পদটি ফাঁকা পড়ে ছিল। প্রসঙ্গত, ১৯৮০-র ডব্লিউবিসিএস তাপসবাবুরই ‘ব্যাচমেট’ হলেন সুশান্তবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy