Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সরকারি হাসপাতাল

ফ্রি পেসমেকারের অপেক্ষায় কাটছে মাসের পর মাস

এ যেন আক্ষরিক অর্থেই রোগী এখন-তখন, ডাক্তার ন’মাসের পথ। লাগামের ব্যবস্থা না করেই ঘোড়া কিনলে ঘোড়া যেমন দাপিয়ে বেড়ায়, স্বাস্থ্য দফতরের অবস্থা এখন অনেকটা তেমনই। সমস্ত চিকিৎসা ফ্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, অথচ কী ভাবে তা রূপায়িত হবে সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনাই হয়নি। সেই কারণেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় নানা ভাবে ধাক্কা খাওয়া শুরু হয়েছে। সর্বশেষ ধাক্কা পেসমেকার।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২০
Share: Save:

এ যেন আক্ষরিক অর্থেই রোগী এখন-তখন, ডাক্তার ন’মাসের পথ।

লাগামের ব্যবস্থা না করেই ঘোড়া কিনলে ঘোড়া যেমন দাপিয়ে বেড়ায়, স্বাস্থ্য দফতরের অবস্থা এখন অনেকটা তেমনই। সমস্ত চিকিৎসা ফ্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, অথচ কী ভাবে তা রূপায়িত হবে সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনাই হয়নি। সেই কারণেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় নানা ভাবে ধাক্কা খাওয়া শুরু হয়েছে। সর্বশেষ ধাক্কা পেসমেকার।

মাত্র একটিই সংস্থা সরকারি হাসপাতালে পেসমেকার সরবরাহ করে। এত দিন তারা বিপিএল পেসমেকার সরবরাহ করত। রাতারাতি সব ফ্রি হয়ে যাওয়ায় পেসমেকারের সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে গেছে। ওই সংস্থা তা সামলে উঠতে পারছে না। ফলে কোনও মেডিক্যাল কলেজেই পেসমেকারের সরবরাহ স্বাভাবিক নেই। মাসের পর মাস রোগীরা অপেক্ষা করছেন। তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। অথচ হাসপাতালে পেসমেকার এসে পৌঁছচ্ছে না। কেন সংস্থার সংখ্যা বাড়ানো হল না, এর পিছনে কী স্বার্থ জড়িত, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। যদিও স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের দাবি, এই সমস্যার কথা তাঁরা জানতেই না।

মেডিক্যাল কলেজগুলি ঘুরে অবশ্য জানা গিয়েছে, কেউ হয়তো অর্ডার দিচ্ছে ২০০টি পেসমেকার। আসছে একশোরও কম। যা আসছে তাই নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যাচ্ছে। কোন্ ডাক্তার তাঁর রোগীকে আগে পেসমেকার বসাবেন, সে নিয়ে নিত্য গণ্ডগোল বাধছে। অপেক্ষায় থেকে থেকে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ভিড়ে ঠাসা মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘বে়ড অকুপেন্সি রেট’ সাঙ্ঘাতিক ভাবে পড়ে গেছে। কলকাতা, জেলা সর্বত্র এক অবস্থা। কোনও রোগী ভর্তি হলে, তাঁর ছুটি পেতে বহু দিন লাগছে। শয্যা খালি না থাকায় বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগে রোগী প্রত্যাখানের ঘটনা গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছে।

স্বাস্থ্য ভবনকে বিষয়টি ওয়াকিবহাল করা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে চাপানউতোর। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পেসমেকার যে সময়মতো সরবরাহ হচ্ছে না, সে সম্পর্কে কেউ আমাদের জানাননি। যদিও জানানোটা উচিত ছিল। কেন হচ্ছে তা খোঁজ নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’’ অন্য দিকে মেডিক্যাল কলেজগুলির কর্তাদের দাবি, তাঁরা সবটাই জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যকর্তারা গুরুত্ব দেননি,

স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের খবরও সেটাই। জানা গিয়েছে, যে সংস্থাটি পেসমেকার সরবরাহ করে, তাদের পক্ষে চাপ সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। সেটা জেনেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সব জায়গা থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করায় এখন বাধ্য হয়েই সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সের মাধ্যমে টেন্ডার ডাকা হয়েছে। সেটা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আপাতত কয়েক মাস এমন সমস্যা চলতেই থাকবে। কেন আগে টেন্ডার ডাকা হল না? এক কর্তার কথায়, ‘‘টেন্ডারের সঙ্গে বহু মানুষের বহু স্বার্থ জড়িত। তড়িঘড়ি সে সব হয় না।’’

ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। এসএসকেএমে একাধিক সঙ্কটজনক অবস্থার রোগীকে এখন অস্থায়ী পেসমেকার বসিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। একই অবস্থা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এনআরএস কিংবা নীলরতন সরকার হাসপাতালে। মেডিক্যালে ভর্তি এক রোগীর আত্মীয়ের কথায়, ‘‘ডাক্তারবাবু বললেন, মাসখানেকের আগে পেসমেকার পাওয়া যাবে না। আমরা বার বার বলছি, আমরা বাইরে থেকে পেসমেকার কিনে দেব। কিন্তু অনুমতি মিলছে না।’’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের হাত-পা বাঁধা। উপর মহল থেকে কড়া নির্দেশ রয়েছে যাতে কোনও রোগীকেই বাইরে থেকে চিকিৎসার সরঞ্জাম কিনে আনতে না হয়। এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগের এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘সাত-পাঁচ না ভেবে এ ভাবে সব কিছু ফ্রি করে দেওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবা উচিত ছিল, কী ভাবে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখবেন। ওঁর খেয়ালখুশির তাল রাখতে গিয়ে রোগীদের প্রাণাম্ত অবস্থা। ’’

রয়েছে অন্য সমস্যাও। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘শুধু যে সরবরাহ অনিয়মিত তা-ই নয়, যন্ত্রেও আকছার গোলমাল দেখা দিচ্ছে। সেটা আবার আরও বড় সমস্যা। রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফের এসে ভর্তি হচ্ছেন।’’ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘রোগী ভর্তি হয়ে স্রেফ শুয়ে থাকছেন। আমরা কিচ্ছু করতে পারছি না। অসহায় লাগছে।’’

সরবরাহকারী সংস্থার কর্তারা দেরির বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। সংস্থার এক কর্তার কথায়, ‘‘যারা মাসে ১৫-২০টা নিত, তারা ১০০ বা ১৫০ চাইছে। আমাদের দেশি সংস্থা। আগে শুধু বিপিএল পেসমেকার সরবরাহ করতাম। এক দিন হঠাৎ স্বাস্থ্যকর্তারা ডেকে বললেন, সমস্ত রোগীকেই এ বার নিখরচায় পেসমেকার দেওয়া হবে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাটা অনেক বেড়ে গেল। আমরা উৎপাদন বাড়াচ্ছি ঠিকই, কিন্তু রাতারাতি হাসপাতালগুলি তিন-চারগুণ পেসমেকার নিতে চাইলে সমস্যা তো হবেই। গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের আর একটু সময় দরকার।’’

কিন্তু মুমূর্ষু রোগীরা সেই সময়টুকু নিজেদের দিতে পারবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE