এ-ও এক উলটপুরাণের গল্প। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নির দাবি করা হচ্ছে। অথচ শিল্পক্ষেত্র থেকে কর আদায়ের বহর কমছে!
পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের দাবি, তৃণমূল শাসনের চার বছরে রাজ্যে ৮৪ হাজার কোটি টাকার লগ্নি এসেছে। এ দিকে চলতি অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজস্ব কর সংগ্রহের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে তো পারছেই না, বরং পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম হতে চলেছে। এই ঘাটতির মধ্যে মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট)-এর অঙ্কই প্রায় তিন হাজার কোটি, যার সিংহভাগ আসার কথা শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র থেকে।
এবং দাবি ও বাস্তবে সংঘাতটা লাগছে এখানেই। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কোনও রাজ্যের শিল্প-পরিস্থিতি ভাল হলে অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে শিল্প থেকে সরকারের আয় বাড়ার কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তেমনটি চোখে পড়ছে না। উল্টে ভ্যাট আদায়ের পড়ন্ত ছবি বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাজ্যের চালু শিল্পগুলোর হালও বিশেষ আশাপ্রদ নয়।
কোনও কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী স্থানীয় বাজারে বিকোলে সে বাবদ সংশ্লিষ্ট রাজ্য ভ্যাট পায়। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বাইরে পণ্য বেচলে সংস্থাকে দিতে হয় কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর (সেন্ট্রাল সেল্স ট্যাক্স, সংক্ষেপে সিএসটি)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাণিজ্য-কর বিভাগের ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের পরিসংখ্যান বলছে, গত প্রায় এক বছরে কয়লা, ইস্পাত, যন্ত্রাংশ, পরিকাঠামো বা পেট্রোকেমিক্যাল্সের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য থেকেও রাজ্যের ভ্যাট আদায় কমেছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের এই ধরনের বিভিন্ন সংস্থাই মোটা অঙ্কের সিএসটি জমা করেছে!
এ হেন তথ্য দেখে কর-কর্তাদের কপালে ভাঁজ। এক বাণিজ্য-কর অফিসারের মন্তব্য, “চালু শিল্প থেকে ভ্যাট আদায় কমে যাওয়াটা চিন্তার। এর মানে, রাজ্যে উৎপাদন শিল্পের কারখানাগুলো এখানকার বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারছে না।”
অর্থাৎ, বাণিজ্যিক কারবারেও ভাটার টান। অর্থমন্ত্রী নিজে এ প্রসঙ্গে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, “ভ্যাট আদায় গত অর্থবর্ষের (২০১৩-১৪) তুলনায় বাড়বে। এতেই পরিষ্কার, রাজ্যে আর্থিক মন্দার তত্ত্ব ঠিক নয়।” যদিও বাণিজ্য-কর কর্তাদের একাংশের যুক্তি: মূল্যস্ফীতির দরুণ ফি বছরই ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়ে, এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। কিন্তু শিল্পে বৃদ্ধির আশা রেখে বাড়তি আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা বাঁধা হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না। “সমস্ত ব্যবসায়িক লেনদেনে ভ্যাট আদায় হয়। তবে শিল্পক্ষেত্র থেকে যতটা ভ্যাট পাওয়ার কথা ছিল, তা মিলছে না। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে অন্য বার্তাবাহী।” বলছেন এক কর-কর্তা। অন্য দিকে অর্থ দফতরের কর্তাটির বক্তব্য, “এখনও মার্চ মাসের আদায় বাকি। অর্থবর্ষ শেষ হলে সব হিসেবই মিলে যাবে।”
অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছেন, যে রাজ্যে বিনিয়োগ যত বেশি, সেখানে ভ্যাট আদায়ের বহর তত বেশি। শিল্পক্ষেত্রে ধারাবাহিক লগ্নির পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড জোরদার থাকায় মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, গুজরাত, অন্ধ্রের মতো রাজ্যে গত অর্থবর্ষে ভ্যাট-আদায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। যা বলে দিচ্ছে, ওই সব রাজ্যে আর্থিক কর্মকাণ্ডের আকর্ষণেই বিনিয়োগ যাচ্ছে। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সমীক্ষা বলছে, গত অর্থবর্ষের তুলনায় এ বছরে রাজ্যে লগ্নির পরিমাণ কমেছে ৭ হাজার কোটি টাকা!
ধরা যাক কয়লা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে, কারখানার জ্বালানি হিসেবে সব সময়ে যার তুঙ্গ চাহিদা। যে রাজ্যে যত বেশি কয়লা বিক্রি হয়, তা থেকে ভ্যাট আদায়ও তত বাড়ে। আর তারই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষাপটে রাজ্যটির শিল্প-পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করে বণিকমহল। ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেড (ইসিএল) সূত্রের তথ্যানুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ইসিএল রাজ্যকে ২৩৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছিল। ২০১৪-১৫’র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিয়েছে ১২৫ কোটি। উল্টো দিকে সিএসটি বেড়েছে। গত অর্থবর্ষে ৮১ কোটি টাকা সিএসটি চুকিয়েছিল যে ইসিএল, চলতি অর্থবর্ষের এক মাস বাকি থাকতেই তাদের দেওয়া কেন্দ্রীয় করের অঙ্ক ১০৯ কোটি!
কেন এমন হল? ইসিএলের ব্যাখ্যা: পশ্চিমবঙ্গে চলতি বছরে কয়লা বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে ভ্যাটও কমেছে। একই ভাবে ইসিএলের কয়লা ভিন রাজ্যে বেশি যাওয়ায় সিএসটি বেশি লেগেছে। তা হলে কি ইসিএল পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে?
ইসিএলের এক কর্তার দাবি, উৎপাদন তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। যে কারণে বাড়তি সেসও জুটেছে রাজ্যের। গত অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ কয়লা বাবদ সেস পেয়েছিল ১১০০ কোটি টাকা। এ বছরে পেয়েছে ১৩০০ কোটি।
কিন্তু কয়লা বিক্রির বহরে টান ধরায় ভ্যাট আদায় কার্যত অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। উৎপাদন ও পরিকাঠানো শিল্পের আর এক অন্যতম উপাদান যে ইস্পাত, তারও এক দশা। দুর্গাপুরের স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সেল) ও বার্নপুরের সেল-আইএসপি (পূর্বতন ইস্কো)’র ভ্যাট কমেছে, বেড়েছে সিএসটি। সেল-এর ইস্পাত বাবদ গত অর্থবর্ষে সিএসটি ছিল ১৩১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। চলতি অর্থবর্ষের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের সিএসটি ১৫৭ কোটি ৫০ লক্ষ।
কয়লা-ইস্পাতের পাশাপাশি পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও রাজ্যের প্রাপ্য বাণিজ্য-করে ভাটার টান। অথচ কেন্দ্রীয় করের স্রোতে জোয়ার। টাটা হিতাচি বা ট্র্যাক্টর ইন্ডিয়া লিমিটেডের মতো পরিকাঠামো যন্ত্রাংশ নির্মাতা সংস্থার কাছ থেকে এ বার ভ্যাট আদায় কমেছে, সিএসটি বেড়েছে। যা দেখে বাণিজ্য-কর বিভাগের কর্তাদের পর্যবেক্ষণ: রাজ্যে আবাসন-রাস্তার মতো পরিকাঠামো-প্রকল্পে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। “হলে ভারী যন্ত্রাংশের বিক্রি বাড়ত। সেই সুবাদে রাজ্যের কপালে ভ্যাটও জুটত অনেক বেশি।” মন্তব্য এক কর-আধিকারিকের।
সব মিলিয়ে কর আদায়ের খাতায় কিন্তু অমিতবাবুর লগ্নি-দাবির প্রতিফলন সে ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy