Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অমিতাভর মৃত্যুতে এত শোক, তাপস, অমিতরা কোথায় গেলেন?

পুলিশ সূত্রের খবর, তিনটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা শাসক দলের নেতা বা ঘনিষ্ঠ সমর্থক। গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত শাসক দলের নেতা তথা ১৫ নম্বর বরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না।

বাঁ দিক থেকে অমিতাভ মালিক, তাপস চৌধুরী, অমিত চক্রবর্তী।—নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিক থেকে অমিতাভ মালিক, তাপস চৌধুরী, অমিত চক্রবর্তী।—নিজস্ব চিত্র।

শিবাজি দে সরকার
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৩৭
Share: Save:

এই শোকের মেয়াদ কত দিন?

দার্জিলিং-এ নিহত সাব ইনস্পেক্টর অমিতাভ মালিকের মৃত্যুর পরে তাঁর মা-বাবা-স্ত্রীয়ের বুকফাটা কান্নার পাশাপাশি ক্রমাগত দাবি উঠছে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের। তবে তা হবে কি না, ভবিষ্যত বলবে। কিন্তু পরিবারের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই বিচারের দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁর বন্ধু-সহকর্মীরাও। কিন্তু এর আগে রাজনৈতিক দলের হাতে খুন হওয়া পুলিশকর্মীদের বিচারই বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকী শীর্ষ মাওবাদী নেতা-নেত্রীরা আত্মসমর্পণ করে সরকারি আতিথেয়তায় চলে যাওয়ার পরে জঙ্গল মহলে নিহত পুলিশকর্মীদের বিচার প্রক্রিয়াও থমকে গিয়েছে।

২০১৪ সালের ৩ জুন দুবরাজপুরের যশপুর পঞ্চায়েতের আউলিয়া-গোপালপুর গ্রামে ১০০ দিনের প্রকল্পে একটি পুকুর সংস্কার করাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও সিপিএমের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমার আঘাতে মারাত্মক জখম হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান দুবরাজপুর থানার সাব ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তী। পরে দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আলিম শেখ-সহ ৫০ জন অভিযুক্তের মধ্যে ধৃত ১৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু সাক্ষী পুলিশকর্মীরাই নিজেদের সহকর্মীর খুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘চিনতে পারছেন না’ বলে দাবি।

২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ডিউটিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সাব ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী। খোদ কলকাতার বুকে ওই পুলিশ অফিসারের খুন হওয়ার ঘটনার পরে সাড়ে চার বছর কেটে গেলেও এখনও শেষ হয়নি বিচার পর্ব। একই ভাবে ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল গিরিশ পার্কে পুরভোটের ডিউটি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কলকাতা পুলিশের এসআই জগন্নাথ মণ্ডল।
ওই মামলাতেও বিচার পর্ব সবে মাত্র শুরু হয়েছে।

পুলিশ সূত্রের খবর, তিনটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা শাসক দলের নেতা বা ঘনিষ্ঠ সমর্থক। গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত শাসক দলের নেতা তথা ১৫ নম্বর বরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের দাবি, এক তৃণমূল নেতার নির্দেশেই তাপসবাবুকে গুলি করেছিল স্থানীয় এক দুষ্কৃতী। সুভান, ইবনে ও আরও কয়েক জন-সহ মুন্নাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সুভান এখনও জেলে থাকলেও মুন্না-সহ বাকিরা জামিনে মুক্ত। ওই ঘটনার ৭৯ দিনের মাথায় তদন্ত শেষ করে সিআই়ডির তরফে মুন্না-সহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আলিপুর আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। চার্জ গঠনের পর বিচার পর্ব শুরুও হয়েছে। ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র সাত জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলার অধিকাংশ সাক্ষীই পুলিশকর্মী। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, সাক্ষ্য গ্রহণের সময়ে অনেক সাক্ষীই তৃণমল নেতা সম্পর্কে নীরব থাকছেন। তবে অভিযুক্তদের আইনজীবী অরিন্দম দাসের দাবি, সবে মাত্র সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আদালতে সাক্ষীরা অভিযুক্ত সুভান-সহ বাকিদের চিহ্নিত করেছেন। তবে তাঁর মতে, সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হওয়াতেই ওই মামলার বিচার পর্ব শেষ হতে সময় লাগছে। ঘটনার পরে সাড়ে চার বছর পার হয়ে গেলেও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ তাপসবাবুর স্ত্রী মিনতি চৌধুরী। সোমবার তিনি বলেন,‘‘প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল ঘটনার। মূল অভিযুক্তেরা বাইরে। দ্রুত যাতে বিচার শেষ হয় সে জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আবেদন করব এ বার।’’

গার্ডেনরিচের পুলিশ অফিসার খুনের মতোই এখনও বিচার শেষ হয়নি গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলের গুলি খাওয়ার ঘটনারও। পুলিশ সূত্রে খবর, ওই ঘটনায় ৯০ দিনের মধ্যেই মূল অভিযুক্ত তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারি-সহ মোট ১৯ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গোপাল-সহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা গেলেও বাকিরা পলাতক। ওই ঘটনায় অভিযুক্তেরা সকলেই শাসক দলের আশ্রিত হওয়ার অভিযোগ উঠলেও শাসক দলের তরফে তা অস্বীকার করা হয়। গার্ডেনরিচের ঘটনার মতো এখানেও অভিযুক্তদের নানা বাধায় চার্জ গঠন হতে দেরি হয়। সবে মাত্র চার্জ গঠন হয়ে বিচার পর্ব শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারির আইনজীবী ফজলে আহমেদ খানের অভিযোগ, ওই ঘটনার অভিযোগকারী কলকাতা পুলিশের অফিসারকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য বারে বারে সমন পাঠানো হলেও তিনি আদালতে হাজির দেননি। ফলে মামলার বিচারে দেরি হচ্ছে। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, অভিযোগকারী বর্তমানে রাজ্য পুলিশে কর্মরত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যস্ত থাকায় তিনি আদালতে আসতে পারেননি।

গিরিশ পার্কের ঘটনায় অভিযোগকারী সাক্ষ্য দিতে না এলেও অমিতবাবুর খুনের ঘটনায় সাক্ষ্য দিতে আদালতে এসেছিলেন ওই মামলার অভিযোগকারী দুবরাজপুর থানার তত্কালীন ওসি ত্রিদিব প্রামাণিক। কিন্তু অভিযোগ, অন্য সাক্ষী পুলিশকর্মীদের মতো তিনিও আদালতে চিনতে পারেননি অভিযুক্তদের। অমিতবাবুর স্ত্রী পুতুল চক্রবর্তীর অভিযোগ, ওই ওসিই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছিলেন। না চিনলে কেন তিনি তাঁদের গ্রেফতার করেছিলেন? বর্তমানে বালুরঘাট মহিলা থানায় কর্মরত পুতুলদেবীর দাবি, অভিযুক্তেরা সকলেই শাসক দলের। তাদের নির্দেশেই বাহিনীর সদস্যেরা অভিযুক্তদের চিনতে পারছে না আদালতে। পুলিশের সর্বোচ্চ মহল সব জেনেও চুপ বলে তাঁর অভিযোগ।

পুতুলদেবী কিংবা মিনতিদেবী, বিচারের আশা না ছাড়লেও গত দশকে মাওবাদী হানায় মৃত পুলিশ কর্মীদের খুনে মূল অভিযুক্তদের সাজা পাওয়ার আশা নেই বলেই মনে করছেন বাহিনীর একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন গড়াই, সাবির আলি মোল্লা অপহরণ-খুনের মামলাই হোক অথবা সাঁকরাইল থানা, শিলদা ক্যাম্প আক্রমণ করে পুলিশকর্মী ও জওয়ানদের খুনের ঘটনায় যাঁরা অভিযুক্ত তাঁরা এখন সরাসরি শাসক দলের হেফাজতে। ওই সব মামলার মূল অভিযুক্ত জাগরি বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতো-সহ একাধিক মাওবাদী নেতা আত্মসমর্পণের নামে সরকারি আতিথেয়তায় রয়েছেন। এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘অমিতাভর খুনে অভিযুক্তদের সাজা হোক। কিন্তু বাকি পুলিশকর্মীদের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তদের সাজার ব্যাপারেও শীর্ষ কর্তাদের নজর দিতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE