Advertisement
২৮ এপ্রিল ২০২৪
নজরে মুখ্যমন্ত্রীর উপনির্বাচন

ভবানীপুরে ২৭ ক্লাবে কোটি টাকা সারদার

টাকা তো নয়, যেন খোলামকুচি! দু’সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার ২৭টি ক্লাবকে প্রায় এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এই তথ্য হাতে এসেছে সিবিআইয়ের। তার চেয়েও বড় কথা হল, যে সময়ে এবং যে এলাকার ক্লাবকে ওই টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেটা থেকেই বড় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তকারীরা। তাঁদের একাংশের ধারণা, ওই টাকা বিলোনোর পিছনে রীতিমতো রাজনৈতিক অঙ্ক ছিল।

শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৫
Share: Save:

টাকা তো নয়, যেন খোলামকুচি!

দু’সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার ২৭টি ক্লাবকে প্রায় এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এই তথ্য হাতে এসেছে সিবিআইয়ের। তার চেয়েও বড় কথা হল, যে সময়ে এবং যে এলাকার ক্লাবকে ওই টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেটা থেকেই বড় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তকারীরা। তাঁদের একাংশের ধারণা, ওই টাকা বিলোনোর পিছনে রীতিমতো রাজনৈতিক অঙ্ক ছিল।

সিবিআই সূত্র বলছে, সারদার টাকা পাওয়া ২৭টি ক্লাব মূলত চারটি থানা এলাকার চেতলা, কালীঘাট, ভবানীপুর এবং আলিপুর। এই চারটি এলাকাই পড়ে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। যে কেন্দ্রের বিধায়ক খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে ওই কেন্দ্রে জয়ী হন তৃণমূলের সুব্রত বক্সী। তৃণমূল সরকার গড়ার পরে তিনি মমতার জন্য ইস্তফা দেন ওই কেন্দ্র থেকে। ভবানীপুরে উপনির্বাচন হয় ২০১১-র ২৮ সেপ্টেম্বর। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, ওই ভোটের সপ্তাহ তিনেক আগে টাকা দেওয়া হয়েছিল ক্লাবগুলিকে।

এই সমাপতন কাকতালীয়, নাকি এর পিছনে শাসক দলের কোনও অঙ্ক কাজ করেছিল, তা-ই এখন খতিয়ে দেখতে চান সিবিআই গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য রাজ্য, এমনকী কলকাতার অন্য কোনও এলাকা নয়, শুধু ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ওই ২৭টি ক্লাবকেই বেছে বেছে কেন টাকা দেওয়া হল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। গোয়েন্দাদের একাংশের মতে, আইআরসিটিসি-সারদা যোগসূত্রের পরে এই ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গেও আরও এক বার প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেলেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

এমনিতে ২০১০ সাল থেকে বছর তিনেক দুর্গাপুজো-সহ বিভিন্ন উৎসবে বিভিন্ন পুজো কমিটি, ক্লাব ও সংগঠনকে দু’হাতে টাকা দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। কখনও নামে, কখনও বেনামে। কিন্তু কোনও আপাত উপলক্ষ ছাড়াই কেন ওই সময় ২৭টি ক্লাবকে টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেটাই ভাবাচ্ছে সিবিআই তদন্তকারীদের।

সিবিআইয়ের জেরায় সুদীপ্ত জানান, ক্লাবগুলিতে টাকা দেওয়ার পিছনে ছিলেন কুণাল ঘোষ। তিনি তখন সারদার গ্রুপ মিডিয়া সিইও। এবং রাজ্যসভার সাংসদ না হলেও তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে যথেষ্ট পরিচিত। সিবিআই গোয়েন্দাদের কাছে সুদীপ্তর দাবি, ভবানীপুর কেন্দ্রের ওই ২৭টি ক্লাবকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর উপরে রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করেছিলেন কুণাল। ২৭টি ক্লাবের তালিকা তৈরি করে কুণালই তাঁকে দিয়েছিলেন।

সুদীপ্তর এই দাবির সঙ্গে কুণালের বয়ান মিলিয়ে দেখেছেন তদন্তকারীরা। সিবিআই সূত্রের খবর, কিছু দিন আগে সুদীপ্ত ও কুণালকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ নিজেও সারদা কর্ণধারের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন।

দু’জনের বক্তব্য একসঙ্গে করে সিবিআই অফিসাররা জানাচ্ছেন, তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথামতোই ক্লাবগুলির পিছনে টাকা ঢালা হয়েছিল। ২০১১-এর সেপ্টেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে তিন পর্যায়ে সুদীপ্তর কাছ থেকে নগদে ওই টাকা আদায় করা হয়। সুদীপ্তর হিসেব মতো তিন দফায় তিনি ৯৮ লক্ষ টাকা কুণালকে দিয়েছিলেন। ২৭টি ক্লাবের মধ্যে ২টি ক্লাবকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। দু’টি ক্লাবকে দেওয়া হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা করে। বাকি ২৩টি ক্লাবের কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেটা এখনও তদন্তকারীদের কাছে স্পষ্ট নয়। সুদীপ্ত মোট যত টাকা দিয়েছিলেন বলে দাবি করছেন, সেটা যথাযথ কি না, তা-ও অন্যান্য সূত্র থেকে খতিয়ে দেখতে চান তাঁরা।

কিন্তু ক্লাবগুলিকে কেন টাকা দিতে বলেছিলেন কুণাল?

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, জেরায় কুণাল জানিয়েছেন, শাসক দলের এক শীর্ষনেতার নির্দেশেই সারদার অফিস থেকে তিন দফায় ওই টাকা নিয়ে কালীঘাটের বাসিন্দা এবং পারিবারিক ভাবে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেন তিনি। সিবিআই-কে কুণাল জানিয়েছেন, কালীঘাটের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি ভবানীপুর এলাকার একাধিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। এলাকায় তাঁর যথেষ্ট প্রভাবও রয়েছে।

কুণালকে জেরা করে ওই ২৭টির মধ্যে কয়েকটি ক্লাবের নামও সিবিআই জেনেছে। তদন্তকারীরা জানান, ওই ক্লাবগুলি ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ রোড, নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিট, রূপচাঁদ মুখার্জি লেন, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, শাঁখারিপাড়া রোড, পদ্মপুকুর রোড ও চেতলা রোডে অবস্থিত। সুদীপ্তও সিবিআই তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, কুণালের দেওয়া ক্লাবগুলির নামের তালিকার প্রতিলিপি সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে রাখা ছিল। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আপাতত তাদের লক্ষ্য, ২৭টি ক্লাবের নামের ওই তালিকা হাতে পাওয়া। রাজ্য সরকারের গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-এর কাছ থেকে পাওয়া বহু নথির মধ্যে ওই তালিকা আছে কিনা, সেটা সিবিআই খতিয়ে দেখছে। তালিকা পাওয়ার পর ওই ক্লাবগুলির ২০১১-র সেপ্টেম্বরের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে দেখবে সিবিআই। এবং তার পর ক্লাবগুলির শীর্ষকর্তাদের তলব করার কথা ভাবছেন তদন্তকারীরা।

এমনিতেই শাসক দল সরকারি টাকায় যে ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাবকে পোষণ করছে, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। সরকারি নথি বলছে, ২০১১ ও ২০১২ সালে রাজ্যের যুবকল্যাণ দফতর ২৩৯৫টি ক্লাবকে ২ লক্ষ টাকা করে অর্থসাহায্য দিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই এই ভাবে জনগণের টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে।

কিন্তু ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যে সারদার কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা নিয়ে কেবল ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ২৭টি ক্লাবকে দেওয়ার পিছনে ঠিক কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটাই এখন জানতে চায় সিবিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE