Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঝাল ঝাড়তে ‘থার্ড ডিগ্রি’ চিকিৎসার শপথ

চিকিৎসক জীবনে পা দেওয়ার মুহূর্ত থেকে তাঁরা শপথ নেন, কোনও রকম বৈষম্য না রেখে রোগীর সেবা করবেন। কিন্তু তাঁদেরই একাংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ কিছু পেশার রোগীকে বিশেষ ‘দাওয়াই’ দেওয়ার নিদান হেঁকেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক এবং পুলিশরা।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৪
Share: Save:

চিকিৎসক জীবনে পা দেওয়ার মুহূর্ত থেকে তাঁরা শপথ নেন, কোনও রকম বৈষম্য না রেখে রোগীর সেবা করবেন। কিন্তু তাঁদেরই একাংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ কিছু পেশার রোগীকে বিশেষ ‘দাওয়াই’ দেওয়ার নিদান হেঁকেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক এবং পুলিশরা। এই দুই পেশার রোগীদের জন্য ‘থার্ড ডিগ্রি’ চিকিৎসার শপথ নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তার এবং হবু ডাক্তারদের একাংশ।

আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে রোগীমৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে গোলমাল এবং মৃতের পরিজনদের হাতে এক জুনিয়র ডাক্তার বেধড়ক মার খাওয়ার পরে রীতিমতো তেতে রয়েছে রাজ্যের চিকিৎসক মহল। বিশেষ করে জুনিয়র ডাক্তাররা। ঘটনার প্রতিবাদে তাঁরা আরজিকরে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিলেন। কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদের এই রাস্তাকে সমালোচনা করেছিল বিভিন্ন গণমাধ্যম। তাতেই তাঁরা খেপে উঠেছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের ফেসবুকের দেওয়াল ভরে গিয়েছে সাংবাদিকদের প্রতি কুৎসিত গালিগালাজে।

অসুস্থ সাংবাদিকদের চিকিৎসা না করার হুমকি থেকে শুরু করে তাঁরা মারা গেলে ডেথ সার্টিফিকেটও যাতে না দেওয়া হয়, সেই নিয়েও রীতিমতো প্রচার চলছে। সাংবাদিক-বিরোধী এই প্রচার এমন মাত্রা নিয়েছে যে, কেউ কেউ ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময়ে সিরিঞ্জে নার্সকে ‘হাওয়া ভরে’ দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।

বিষয়টি সামনে আসার পরে নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছে সব মহলে। প্রাক্তন স্বাস্থ্যকর্তা থেকে শুরু করে আইন বিশেষজ্ঞ, বর্তমান স্বাস্থ্যকর্তা, মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্তা, চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধি এমনকী জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনও এর প্রতিবাদ করেছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো ভাবতেই পারছি না! ডাক্তারদের মুখে কি এই সব প্রলাপ মানায়? পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ করছে না কেন?’’ প্রাক্তন আইনমন্ত্রী নিশীথ অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘এটা সরাসরি মানহানির পর্যায়ে পড়ে।’’ আইনজীবী শেখর বসু বলেন, ‘‘এটা মেডিক্যাল এথিকস-এর বিরোধী।’’

সম্মিলিত এই নিন্দার সামনে পড়ে শুক্রবার বিকেলের দিকে বিতর্কিত পোস্টগুলি তুলে নেওয়া হয়। ফোনে নিঃশর্ত ক্ষমাও চান কেউ কেউ।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শুধু ক্ষমা চাইলে বা পোস্ট তুলে নিলেই কি কথাগুলোর প্রভাব ফিকে হয়ে যায়?

তাঁদের মানসিকতা কি রাতারাতি বদলে যেতে পারে? বারবার যে অভিযোগ ওঠে, ইমার্জেন্সি বা আউটডোরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীকে জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের দুর্ব্যবহারে জেরবার হতে হয়েছে, এই সব মন্তব্য কি সেই অভিযোগকেই সত্যতার ভিত্তি দেয় না? এত সহজে যাঁরা রোগীকে ‘থার্ড ডিগ্রি’ দেওয়ার বিধান দিতে পারেন, তাঁদের মধ্যে আদৌ কি সেবার মানসিকতা থাকে?

আশঙ্কার বিষয় হল, জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের এই ধরনের কথাবার্তায় তাঁদের সতীর্থদের কাছ থেকে কিন্তু তেমন জোরালো প্রতিবাদ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। প্রবীণ চিকিৎসকদের অনেকেই খেদের সঙ্গে বলছেন, ইদানীং তো চোর সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ মারার মতো অভিযোগও ওঠে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে! তার পাশে ফেসবুক পোস্টে থার্ড ডিগ্রির হুমকিতে আর বিস্ময়ের কী আছে! চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন যে আশু জরুরি, তা মেনে নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাসের মন্তব্য, ‘‘চিকিৎসকদের আরও একবার তাঁদের দায়িত্বের কথা মনে করাতে, আরও একবার মেডিকো-লিগাল দিকটা ঝালাই করাতে আমরা আগামী ২১ থেকে ২৩ জানুয়ারি একটা কর্মশালা করাচ্ছি।’’

কিন্তু কর্মশালা করে কি আর রাতারাতি মানসিকতা পাল্টে ফেলা সম্ভব? চিকিৎসক সংগঠন আইএমএ-র সম্পাদক শান্তনু সেন বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই কোনও জুনিয়র ডাক্তার বা হবু ডাক্তার এই জাতীয় কথা বলতে পারেন না। অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব।’’ চিকিৎসক সংগঠনের তরফেও ওই ধরনের মন্তব্যের বিরোধিতা করা হয়েছে। ডিএসও-র তরফে কবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘আন্দোলনের পর্যায়ে এমন মন্তব্য অনভিপ্রেত। আমরা কোনও ভাবেই এটা সমর্থন করি না। তবে এটাও ঠিক, যে চাপের মধ্যে জুনিয়র ডাক্তাররা কাজ করেন তার পরিবর্তন দরকার।’’

পিতম অধিকারী নামে যে জুনিয়র ডাক্তার সাংবাদিকদের ‘থার্ড ডিগ্রি’ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এ দিন বিকেলে তিনি সুর বদলে ফেলেছেন। বিষয়টি নিয়ে ‘খবর হচ্ছে’ জেনে পিতম বলেন, ‘‘না, না, আপনারা তো হাসপাতালের কল্যাণে অনেক কাজ করে থাকেন। আমি ক্ষমা চাইছি। এ বার থেকে ১০০ শতাংশ মনোযোগ দিয়ে রোগীদের জন্য কাজ করব।’’ যাঁর ফেসবুক পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে পিতম ওই মন্তব্য করেছিলেন, সেই জুনিয়র ডাক্তার রঞ্জুশ্রী মণ্ডল বলেন, ‘‘আমি কোনও ভাবেই এই ধরনের বক্তব্যকে সমর্থন করি না। তবে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি মিডিয়ার একাংশ যে ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, আমি তারও বিরোধী।’’

যে প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রিটাসের নামে শপথ নিয়ে পেশায় আসেন ডাক্তাররা, তিনি বলেছিলেন, ‘ডাক্তারি পেশার শৈলীটা শেখার পক্ষে একটা জীবন ব়ড্ড ছোট’ (দ্য লাইফ ইজ সো শর্ট, দ্য ক্রাফট সো লং টু লার্ন)। প্রবীণ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই আত্মসমালোচনার সুরে বলেছেন, এই ডাক্তারি শৈলীর মধ্যে তো শুধু ছুরি-কাঁচি ধরা বা ওষুধ দেওয়া পড়ে না। পড়ে রোগীর আস্থা অর্জন করার কলাও। সেটা ক’জন শিখতে পারছেন, সেই নিয়েই সংশয় রয়েছে। যাঁরা ফেসবুকে আপত্তিকর কথাবার্তা লিখছেন, তাঁরা সত্যিই এর পরিণাম ভেবে লিখেছেন তো? প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা জয়শ্রী মিত্র ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বিশ্বাস, অর্থটা জানলে এমন ন্যক্কারজনক কথা ওঁরা বলতে পারেন না। ডাক্তারি যতই একটা পেশা হোক, আর যতই তা ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় আসুক, ডাক্তার-রোগী সম্পর্ককে আর পাঁচটা সম্পর্কের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE