Advertisement
১০ মে ২০২৪

হাঁটার ধরন দেখে গ্রেফতার খুনি

মাথা চাদর দিয়ে মোড়া। হাতে একটি ব্যাগ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এক যুবক। মালদহের ইংরেজবাজার এলাকার রামরতন অগ্রবাল, তাঁর স্ত্রী মঞ্জুদেবী ও পরিচারক গণেশ রামকে খুনের তদন্তে নেমে সিসিটিভির ফুটেজ থেকে এমন এক ব্যক্তির ছবি পেয়েছিল পুলিশ।

কৌশিক ঘোষ ও অভিজিৎ সাহা
কলকাতা ও মালদহ শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৬ ০২:৪৬
Share: Save:

মাথা চাদর দিয়ে মোড়া। হাতে একটি ব্যাগ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এক যুবক।

মালদহের ইংরেজবাজার এলাকার রামরতন অগ্রবাল, তাঁর স্ত্রী মঞ্জুদেবী ও পরিচারক গণেশ রামকে খুনের তদন্তে নেমে সিসিটিভির ফুটেজ থেকে এমন এক ব্যক্তির ছবি পেয়েছিল পুলিশ। সেই ফুটেজ থেকেই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়লেন অগ্রবাল পরিবারের আর এক পরিচারক নির্মল সিংহ। রবিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মালদহ থানার নারায়ণপুরে বোনের বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন তাঁকে ১৪ দিনের সিআইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তভার হাতে নেওয়ার তিন দিনের মধ্যেই ঘটনার কিনারা করে ফেলল সিআইডি। তাতে স্বস্তি পেয়েছেন মালদহের ব্যবসায়ীরাও।

রামরতনবাবুর বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটি ভবনে সিসিটিভি ছিল। সেই সিসিটিভির ফুটেজ থেকেই জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত সওয়া এগারটা নাগাদ নির্মল রামরতনবাবুর বাড়িতে বেল বাজান। মুখ ঢাকা থাকলেও এই যুবকের হাঁটাচলা এবং আকৃতি দেখে সন্দেহ হয়, এই যুবক এই বাড়িরই প্রাক্তন পরিচারক নির্মল। মাস ছয়েক আগে তিনি এই বাড়িতে কাজ করতেন। এরপরেও বাড়িতে পরিচারক না থাকলে অস্থায়ী ভাবে তাঁকে মাঝে মধ্যেই কিছু দিনের জন্য রাখা হত। সম্প্রতি, গত ১৪ থেকে ১৬ জুলাইও নির্মলকে তিন দিনের জন্য কাজে বহাল করা হয়।

রামরতনবাবুকে খুনের কিনারা করে সোমবার কলকাতায় সিআইডির সদর দফতরে সাংবাদিকদের এ কথা বলা হয়। ডিআইজি (স্পেশ্যাল) সিআইডি তাপস দাস ছাড়াও এ দিন সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত ছিলেন ডিআইজি (অপারেশন) সিআইডি দিলীপ আদক। রামরতনবাবুর পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, নির্মলের ব্যবহার খারাপ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে চুরিরও অভিযোগ ছিল। বেশ কিছু দিন আগে তিনি মঞ্জুদেবীর কাছ থেকে দু’হাজার টাকা চেয়েছিলেন। ২০০ টাকা দিয়েছিলেন মঞ্জুদেবী। নির্মল বাড়ি করবে বলে ফের চল্লিশ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। তা তাঁকে দেওয়া হয়নি। তা নিয়ে নির্মলের সঙ্গে মঞ্জুদেবীর ঝগড়া হয়েছিল। এরপর ছ’মাস আগে তাঁকে কাজ থেকে পুরোপুরি বরখাস্ত করা হয়। তাপসবাবু বলেন, ‘‘জেরায় নির্মল স্বীকার করেছেন, তাঁকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ায় রাগ ছিল। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই বাড়ির তিন জনকে খুন করেছে।’’ তাপসবাবু জানান, এ ছাড়াও নির্মলের ধারণা, রামরতনবাবুর অনেক সম্পত্তির মালিক। এই বাড়ি থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া যেতে পারে ভেবে লুঠপাট করতে চেয়েছিল।

বৃহস্পতিবার রাতে শহরের বিবেকানন্দ পল্লিতে নিজের বাড়িতেই এক পরিচারক সহ সস্ত্রীক খুন হন রামরতনবাবু। একই বাড়িতে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটায় শহর জুড়ে ক্ষোভ ঘনায়। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। শহরে ৪৮ ঘন্টার ব্যবসা বন্‌ধেরও ডাক দেওয়া হয়। খুনের ঘটনার কিনারা হওয়ার পরে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, ঠান্ডা মাথায় তিন জনকে খুনের পরে দেহগুলি চাদর দিয়ে ঢেকে প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে ঘরের আলমারি, ড্রয়ার খুলে প্রায় আড়াই কেজি সোনার গয়না নেন নির্মল। মঞ্জুদেবীর শরীরের গয়না অধিকাংশ যে নকল সোনার, সেটা নির্মল জানতেন বলেই তা নেননি। ওই পুলিশ কর্তা জানান, ধৃত জেরার মুখে সবই কবুল করেছে।

পুলিশ নির্মলকে ডেকে জেরা করার সময়েই তার মাথা ন্যাড়া দেখে সন্দেহ বাড়ে। পুলিশ জানতে পারে, নির্মল শুক্রবার মাথা ন্যাড়া করেছেন। সিআইডির আধিকারিকদের অনুমান, মাথার চুলে রক্তের দাগ থাকার ফলেই নির্মল চুল কেটে ফেলেছে। তবে, পাছে কেউ তাঁকে কেউ চিনতে না পরেন সেই কারণেও চুল কাটা হতে পারে।

পুলিশ ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য নির্মলকে বাড়ির গেটে নিয়ে যায়। সিসিটিভি ক্যামেরায় তা রেকর্ড করে আগের ফুটেজে পাওয়া ব্যক্তির চলাফেরার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। এর পরে নির্মলের স্ত্রী, মাকে পুলিশ জেরা করে জানতে পারে, ঘটনার রাতে নির্মল রাত ১০টা থেকে আড়াইটে পর্যন্ত বাড়িতে ছিলেন না। সেই রাতে বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতেও নির্মল গিয়েছিলেন বলে জানতে পারে। লাগাতার জেরার মুখে নির্মল ভেঙে পড়ে খুনের কথা কবুল করে। পরে পুলিশ গিয়ে গয়না উদ্ধার করে।

পুলিশ জানায়, নির্মল গেট খুলে ঢুকে প্রথমে প্রৌঢ় পরিচারক গমেশ রামের মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করেন। এর পরে চপার দিয়ে গলার নলি কেটে খুন করেন তাঁকে। শব্দ শুনে মঞ্জুদেবী দোতলা থেকে নেমে এলে তাঁকেও একই ভাবে খুন করেন নির্মল। কিছু ক্ষণ পরে কাজ সেরে রামরতনবাবু বাড়ি ফেরেন। তখন দরজা খুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে একই কায়দায় তাঁকেও খুন করা হয় বলে পুলিশের দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

servant murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE