Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রমজানি ইদ আর বেস্পতির লক্ষ্মীতে খুশির আলো

হিন্দু-মুসলিমের চিরকেলে খোপকাটা ভাগগুলো কেমন গুলিয়ে যায় এ ঘরে ঢুকে। টুম্পা সগর্বে বলেন, ‘‘আমি খারাপপাড়ার মেয়ে কি না, সমাজের রীতি বুঝি কম!’’ পুজো এলেই, পাশের ঘরের স্বর্গগত ফরিদা মাসির কথা ভেবে মন কেমন! তাঁর সঙ্গী, মানে ‘মেসো’র দেখাদেখি মজা করে ইফতারের লোভে এক-একদিন রোজা রাখত কিশোরী টুম্পা।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:২১
Share: Save:

বা রে, আমি কাজে দিল্লি গেলে তো, মায়ের কাছেই মেয়েকে রাখব। পুজোর একটা রাত্তিরে কী ক্ষতি...

কেন এক বছর পুজোয় রাতে ঠাকুর না-দেখলে তোমার ভাত হজম হবে না?

শোন, মেয়ের বাপ হয়েছ বলে শয়তানি চলবে না...পুজোয় একদিন আমায় ঘুরতে নিয়ে যেতেই হবে!

বৌয়ের এই টরটরিয়ে ঝগড়ুটেপনায় হেসে ফেলেন, সাবির মণ্ডল। অটোচালক বরকে ওলভাতে কাচকি মাছের চচ্চড়ি বে়ড়ে দিতে দিতে অপরাজেয় টুম্পা অধিকারী। কালীঘাটের যৌনপল্লির ঘুপচি ঘরগুলোর দুপুর জুড়ে গেরস্থালির গন্ধ। পায়ে-পায়ে ঘোরে বেড়াল আর বেজে ওঠে দাম্পত্যের মিঠে টুং-টাং। খাটে শোওয়া কাজলের টিপপরা তুলোর পুঁটলিটির দিকে ক্ষণে-ক্ষণে তাকান নতুন মা-বাবা। টুম্পা বলেন, রমজানি ইদের তিন দিন আগে জন্মাল বলে নাম রেখেছি খুশি। সাবির হাসেন, বেস্পতিবার মেয়ে হতেই বুঝে যাই লক্ষ্মী এসেছে।

হিন্দু-মুসলিমের চিরকেলে খোপকাটা ভাগগুলো কেমন গুলিয়ে যায় এ ঘরে ঢুকে। টুম্পা সগর্বে বলেন, ‘‘আমি খারাপপাড়ার মেয়ে কি না, সমাজের রীতি বুঝি কম!’’ পুজো এলেই, পাশের ঘরের স্বর্গগত ফরিদা মাসির কথা ভেবে মন কেমন! তাঁর সঙ্গী, মানে ‘মেসো’র দেখাদেখি মজা করে ইফতারের লোভে এক-একদিন রোজা রাখত কিশোরী টুম্পা। এখন মুসলিম বাড়ির বৌ— বিজয়ায় এ গলির মুখে সেজেগুজে দাঁড়ানো দিদি-মাসিদের মুখে সিঁদুর লেপে দেন চেপে-চেপে। মায়ের লক্ষ্মীপুজোয় নাড়ু পাকাতে, লুচি-সুজির পায়েস বানাতে হাত লাগান। টুম্পার শ্বশুরবাড়িও এ নাড়ুর ভক্ত।

যৌনকর্মী মায়ের মেয়ে অঙ্কে কাঁচা বলে আকছার স্কুলে গাল খেতে হতো, ‘‘তোমার আর কী, ক’দিন বাদেই তো রং মেখে দাঁড়াবে।’’ টুম্পারও রোখ চাপে, মায়ের পেশায় যাব না, কিন্তু এ গলিকেও কখনও ভুলব না। সাবিরের সঙ্গে আলাপের সময়ে তিনি জানতেন না টুম্পা কোন গলির মেয়ে। কিন্তু সম্পর্কটা দানা বাঁধছে টের পেয়ে সটান সব কিছু বলতে দ্বিধা করেননি দৃপ্ত তরুণী। কালীঘাটের গলির বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখান! পাচারের ফাঁদ বা যৌন অত্যাচারের বিপদ বোঝান টুম্পা। কাজের সুবাদে জুটছে দেশ-বিদেশের ফেলোশিপ। ‘‘দিল্লিতে বিলেতের মন্ত্রীর সামনে গুছিয়ে লেকচার দিয়েছে ও’’— বৌয়ের গর্বে কলার তোলেন সাবির।

এ পাড়ার মেয়ের পক্ষে পুরুষকে বিশ্বাস করা সোজা ছিল না। বাবা বলে যাকে জানতেন, মাকে বেধড়ক পেটাত সেই লোকটা। পরীক্ষার পড়া মাথায় উঠত। সাবির এসে সব ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছেন। টুম্পা শোনান, ‘‘আমাদের বিয়েটা কিন্তু দারুণ মজার! তিন বার, তিন রকমের বিয়ে।’’ বড়দের বাগড়ার ভয়ে রেজিস্ট্রি গোড়াতেই সেরে ফেলা হয়। তারপর শ্বশুরবাড়ির দাবিতে টোপর পরেন সাবির। ক’মাস বাদে টুম্পাও বরকে নিকাহ করেছেন।

পুজোয় তরুণ দম্পতি, ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। ছোটবেলায় মা একবারই ঠাকুর দেখাতে পেরেছিল টুম্পাকে! পরে মাকে ছেড়ে মাসিদের সঙ্গে যেতে মন চাইত না। বিয়ের তিনটে বছর মানেই মুক্তির পুজো। রাত দশটা অবধি অটো চালিয়েও বৌকে নিয়ে রাতভর কলকাতা চষে ফেলতে তরতাজা সাবির। গড়িয়া থেকে হরিদেবপুর, বেহালা-নিউআলিপুর, সেলিমপুর— বাদ নেই কিছুই! ম্যাডক্সের আড্ডা থেকে কালীঘাট হাই স্কুলমাঠের সিঁদুর খেলা, সব চাই টুম্পার।

একরত্তি মেয়ের প্রথম পুজো এ বার! তাকে একবারটি প্যান্ডেলে নিয়ে যাবেনই তরুণী মা। আনকোরা তুলতুলে মোজা-ফ্রক দেখে আশ মেটে না বাপের। খুশির আলো উপচে পড়ে চিলতে ঘরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE