ঘরছাড়াদের বাড়ি। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
ধানের বীজতলায় মুখ দিয়েছিল ছাগল। তা নিয়ে মারপিট। শেষে বোমাবাজি-অগ্নি সংযোগে গ্রামে ধুন্ধুমার বেধেছিল দু’পক্ষের। তার জেরে গত বারো মাস গ্রামছাড়া মেয়েটি। লাটে উঠতে বসেছে তার এবং তারই মতো আরও পঁচিশ জন পডুয়ার পড়াশোনা। বীরভূমের রামপুরহাট থানার বগটুই গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক ছাত্রী তাদের এই দশার কথা সম্প্রতি চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছে। আবেদন করেছে গ্রামে ফেরানোর ব্যবস্থা করার। শান্তিতে বাস করার সুযোগ দেওয়ার। বছরখানেক ধরে বগটুইয়ে ঝামেলা চলছে কংগ্রেস
এবং তৃণমূলের। এক দিকে, গ্রামের বাসিন্দা তথা স্থানীয় বড়শাল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের জামকলি শেখ। বিপক্ষে কংগ্রেস নেতা আঙুর শেখ। গ্রামছাড়া পরিবারগুলির অধিকাংশ এলাকায় কংগ্রেস সমর্থক বলেই পরিচিত। সংখ্যায় ৭৭ জন।
গত বছর ছাগল নিয়ে ওই সংঘর্ষের পর থেকেই আঙুর এবং তাঁর স্ত্রী জেসমিনা বিবি (যিনি পঞ্চায়েত সদস্যাও) গ্রামছাড়া। ঘটনার জন্য গ্রামেরই চার তৃণমূল নেতা-কর্মীকে দুষে মেয়েটি চিঠিতে লিখেছে, ‘‘(ওরা) কেউ গ্রামে গেলে তার উপরে অকথ্য অত্যাচার করে, মেরেধরে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যে মেয়েটি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছে, এই পরিবেশে গত বছর সে উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করতে পারেনি। এ বছর অন্য গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে গ্রাম নিয়ে তার ভয় কাটেনি এখনও। মেয়েটি লিখেছে, ‘‘দুষ্কৃতীরা মহিলাদের উপরে অত্যাচার করে।...সব সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নির্ভয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’
শুক্রবার বগটুই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ঘরছাড়া পরিবারগুলির পাকা বাড়িগুলোর গ্রিল, দরজা, জানলা ভাঙা। খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে মাটির বাড়িগুলি। তেমনই একটি বাড়িতে দেখা মিলল, সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার। জানালেন, পরিবারের সবাই ঘরছাড়া। নিজে বড় ছেলের সঙ্গে রামপুরহাটে থাকেন। তবে স্বামীর ভিটের মায়া কাটাতে পারেন না বলে প্রায়ই চলে আসেন। কেউ আটকায় না? বৃদ্ধা বলেন, ‘‘আমার মতো বুড়িকে ওরা পাত্তা দেয় না। কিন্তু কমবয়সী ছেলেমেয়েদের ঢুকতে দেবে না।’’
তাই কি? বৃদ্ধার বাড়ি থেকে কয়েক পা এগিয়ে ঘরছাড়াদের নিয়ে খোঁজ নিতেই জমল ভিড়। ঘিরে ধরা লোকজন জানতে চাইল, ‘‘কী দরকার ঘরছাড়াদের খবরে?’’ জটলার নেতৃত্বে জামকলি শেখ, যিনি মেয়েটির চিঠিতে অন্যতম অভিযুক্ত।
সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তাঁর দাবি, ‘‘তৃণমূল নয়, জনতা ঘরছাড়া করেছে ওই সব পরিবারকে। কংগ্রেস সমর্থক ওই সব পরিবারের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। ওরা ফিরলে গ্রাম ফের অশান্ত হবে।’’ চিঠিতে অভিযুক্ত হিসেবে নাম থাকা জামকলির তিন সঙ্গী—লালন শেখ, পলাশ শেখ এবং টোটন শেখ আবার বলেন, ‘‘ওই সব পরিবারে কোনও পড়াশোনা করা ছেলেমেয়ে নেই।’’ তবে জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির ক্ষোভ, ‘‘তৃণমূলের অত্যাচারে ওই পড়ুয়ারা এবং তাদের পরিবার দীর্ঘদিন ঘরছাড়া। পুলিশ-প্রশাসন জেনেও পদক্ষেপ করে না।’’
মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি, ডাকযোগে একই চিঠি বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী এবং পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারের কাছেও পাঠিয়েছে ওই স্কুলছাত্রী। বহু চেষ্টা করেও এ দিন জেলাশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। চিঠি হাতে পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার। এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাসের দাবি, গত বিধানসভা ভোটের আগে ওই পরিবারগুলিকে এক বার গ্রামে ফেরানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘তার পরে ওখানে কী হয়েছে খোঁজ নিতে হবে।’’ অভিযোগ শুনে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ঘটনার সত্যতা যাচাই করার দরকার আছে।’’ তবে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যাপারটা দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy