নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১১৯তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর রচনার একটি সংকলন উপহার দেওয়া হল অমর্ত্য সেনকে। শনিবার কলকাতার নেতাজি ভবনের একটি অনুষ্ঠানে। ছবি: পিটিআই।
কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও নরেন্দ্র মোদী। অপ্রকাশিত নেতাজি-ফাইল আমজনতার সামনে খুলে দিয়ে দেশ জুড়ে গণ আবেগে সওয়ার হতে চাইছেন দু’জনেই। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশবাসীর জন্য এ এক বিশেষ দিন। আর নেতাজির মৃত্যু কবে, কী ভাবে তা নিয়ে বার বার রহস্য উসকে দিচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার, নেতাজি-জয়ন্তীতে এলগিন রোডের নেতাজি ভবনে তাঁর বক্তৃতায় ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফাইল প্রসঙ্গে মুখ খুলে যেখানে রহস্য নেই, সেখানে রহস্য খোঁজার প্রবণতাকে তুলোধোনা করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
কীসের রহস্য
এখানে ঢোকার সময়েই অনেকে জানতে চাইছিলেন, যে ফাইল প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে কী প্রত্যাশা করছি। ফাইলে কী আছে তা নিয়ে কেন কৌতূহলী হব? এ তো আগাথা ক্রিস্টির কোনও উপন্যাসের শেষে কী হল, তা নয়। ...আদৌ কোনও রহস্য আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। থাকলেও নেতাজির মতাদর্শ বা জীবন-দর্শনের বিষয়ে তা গভীর কোনও ছাপ ফেলবে বলে মনে হয় না। (প্রশ্নরত সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে) যেটা আসল বিষয় আপনারা তাতে মন দিন। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে এত উত্তেজিত হবেন না। ...মোদ্দা কথা, নেতাজি দেশের স্বাধীনতা, সংহতি, সাম্য, সুবিচার, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বর্জন করেছিলেন। ফাইলে যা-ই প্রকাশিত হোক, এই সত্য তাতে বদলাবে না।
আমি নিঃসংশয়
ঠিক কী ভাবে দুর্ভাগ্যক্রমে নেতাজির অন্তিম মুহূর্ত এসেছিল, তা নিয়ে আমার সংশয় নেই। অনেকে হয়তো তা মানতে পারেন না। কিন্তু মানতে না-পারার কারণ নেই। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষপর্বে নেতাজি মারা গিয়েছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। কিংবা অন্য ভাবেও যদি তিনি মারা গিয়ে থাকেন... এখনও বেঁচে থাকাটা তো অবিশ্বাস্য। কী ভাবে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যু— তার থেকে জীবন ঢের গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে কোনও মানুষকেই শুধুমাত্র বিক্ষিপ্ত ঘটনার ভিত্তিতে দেখা ঠিক নয়। তাঁর চিন্তা, আদর্শই বড় কথা। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোয় এই দৃষ্টিকোণ থেকেই নেতাজিকে নিয়ে চর্চা হয়। মৃত্যুদিনে কী আসে-যায়! নেতাজির ক্ষেত্রে তো কিছুই আসে যায় না। নেতাজির নেতৃত্বগুণ, তাঁর ভাবনার দর্শন ঐতিহাসিক। মৃত্যু নেতাজির পরিপূর্ণ, যুগান্ত সৃষ্টিকারী জীবনের শেষ, এটুকুই! তিনি জীবনে যা করেছেন, তার সঙ্গে তুলনায় মৃত্যু সামান্য। নেতাজির মৃত্যু নিয়ে আগ্রহ, বড়জোর অতীত নিয়ে কৌতূহল মেটাবে। এর বেশি কোনও গুরুত্ব নেই। ...নেতাজি এ দেশের স্বাধীনতা, সাম্য ও সুবিচারের লক্ষ্যে প্রাণ দিয়েছিলেন।
উদ্ভট ধারণা
অতীত নিয়ে কৌতূহল মেটানো ছাড়া নেতাজির মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে আনাটা ক্ষুদ্রমনস্ক রাজনীতি। যে পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা এই ধরনের রাজনীতিতে ইন্ধন দিয়েছে। ...যাঁরা ভাবেন নেতাজি পরবর্তী জীবনে হিন্দু সাধু হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা নেতাজি কী ছিলেন, বুঝতে গভীর ভুল করেছেন। ...আর নেতাজির জীবন শেষ হওয়ার পিছনে কংগ্রেস সরকারেই আসলে দায়ী ভাবাটা বেশ উদ্ভট। এর একটাই ব্যাখ্যা, আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিসন্ধিমূলক রাজনীতির পক্ষে এ-সব সুবিধাজনক। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
বাস্তববাদী নেতাজি
গাঁধী ও সুভাষের মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু মতপার্থক্য থাকলেও ওঁরা এক সঙ্গে কাজ করার পথ খুঁজে বার করতেন। গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধায় নেতাজির কুণ্ঠা ছিল না। আজাদ হিন্দ ফৌজেই গাঁধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড ছিল। ...হরিপুরা কংগ্রেসের সময়ে নেতাজি জাপানকে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। (জাপান তখন চিন আক্রমণ করেছে। সুভাষ তার নিন্দা করেন। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি চিনে মেডিক্যাল মিশনও পাঠিয়েছিলেন।) পরে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজনে জাপানেরই হাত ধরেন। এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। ...সুভাষ ছিলেন প্র্যাগমেটিক (বাস্তববাদী)।
আদর্শই উপেক্ষিত
আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুলে বিভাজনের বোধ গেঁড়ে বসেছে। তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি অপশব্দ হয়ে উঠেছে। অপেক্ষা করছি কবে গণতন্ত্র বা হয়তো স্বাধীনতাও তেমনই খারাপ (সহাস্যে) শব্দ বলে ধরা হবে। আমরা বরং এমন একটা শব্দ খুঁজছি, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখেও মেলবন্ধন ঘটাবে, শুধু সহিষ্ণুতা নয় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধেরও জন্ম দেবে, ভারত এবং গোটা পৃথিবীর যা দরকার। ...সম্প্রদায় বা জাতপাতের বিভাজনে নেতাজি বিশ্বাস করতেন না। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে পুরোপুরি আপসহীন ছিলেন। ...নেতাজি নিছকই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেননি। তিনিই প্রথম এ দেশে সমাজের কিছু অসাম্যের দিকটি খেয়াল করেছিলেন। তা নিয়ে বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান করেছিলেন। এবং ধিক্কার জানিয়ে সমাজকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন। নেতাজির ভাবনা আজকের ভারতেও বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি সাম্য ও সুবিচারের কথা বলেছেন। আমি মনে করি না, স্বাধীন ভারতে কোনও সরকারই এই দিকগুলি নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছে। আর এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা তো আরও কম করছেন। আজ আমরা যে-পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, তাতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুভাষের ভারত-দর্শনের প্রেরণা দরকার। ...নেতাজি মূল স্রোতের জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি এক জন মহান র্যাডিকাল (বিপ্লবী) নেতা, ছক-ভাঙা দিশারী ছিলেন। ...এখন এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের নাম করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে। আমার মনে হয় না মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পারসি, শিখ বা বৌদ্ধদের সঙ্গে বেশির ভাগ হিন্দুর কোনও বিরোধ আছে। এটা প্রধানত রাজনীতির খেলা। আর কিছু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা আছে। সুভাষ এবং তাঁর আদর্শের নামে এর প্রতিরোধ করুন।
(বন্ধনীভুক্ত শব্দ বক্তৃতার অংশ নয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy