Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ধৃত তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-ও

রাজ্যের শাসক দলের নতুন গয়না এ বার ইউএপিএ! ক্ষমতায় এলে ওই ‘কালা কানুন’ রাজ্যে প্রয়োগ করবেন না বলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা তিনি পালন করেননি। তৃণমূল আমলে ইউএপিএ বা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে পাঁচ-ছ’জন মাওবাদী নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:০২
Share: Save:

রাজ্যের শাসক দলের নতুন গয়না এ বার ইউএপিএ!

ক্ষমতায় এলে ওই ‘কালা কানুন’ রাজ্যে প্রয়োগ করবেন না বলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা তিনি পালন করেননি। তৃণমূল আমলে ইউএপিএ বা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে পাঁচ-ছ’জন মাওবাদী নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে।

আর এ বার তৃণমূল দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত দু’জন অভিযুক্ত হতে চলেছেন ওই আইনে। এঁরা হলেন গার্ডেনরিচের চর-কাণ্ডে রবিবার ধৃত বন্দরে তৃণমূলের শ্রমিক নেতা ইরশাদ আনসারি ও তাঁর ছেলে তথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা আসফাক। শুধু তা-ই নয়, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা ওই বাবা-ছেলেকে লখনউয়ে নিয়ে গিয়ে জেরা করার জন্য আদালতে আবেদন জানাবে।

সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ ও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে সামিল হওয়ার মামলা রুজু করা হয়েছে আগেই। আবার বীরভূমে তৃণমলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও বিধায়ক মনিরুল ইসলামের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কারও বিরুদ্ধে কখনও ইউএপিএ-তে মামলা রুজু হয়নি। দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার অভিযোগেই ইউএপিএ প্রয়োগ করে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি।

রবিবার ইরশাদ, আসফাক এবং ইরশাদের শ্যালক জাহাঙ্গিরকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) দেশদ্রোহের মামলা রুজু করেছিল। তবে লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা এ দিন বলেন, ‘‘ইরশাদ ও আসফাকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-ও দেওয়া হবে। প্রাথমিক ভাবে যেটুকু তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি, তাতে ওই আইন প্রয়োগ করায় অসুবিধে নেই।’’

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, ‘‘অহেতুক দলের নাম জড়ানো হচ্ছে। ওই দু’জনের সঙ্গে দলের কোনও সংস্রব নেই। ওদের সদস্য পদও দেওয়া হয়নি।’’ তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল আগাগোড়া দেশপ্রেমিক দল। আমাদের নেত্রী বার বার দেশের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে সওয়াল করেন। দলের কর্মীদেরও দেশপ্রেমের আদর্শে শিক্ষা দেওয়া হয়।’’ আবার এ দিনই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু পুরুলিয়ার আদ্রায় বলেন, ‘‘গোটা তৃণমূল দলটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্ল্যাক হোল রয়েছে। যখন ধরা পড়ে, তখন আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে।’’

গত ১৪ নভেম্বর মধ্য কলকাতা থেকে ধৃত সন্দেহভাজন পাক চর আখতার খান ও তার ভাই জাফরের বিরুদ্ধে প্রথমে দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়। পরে ইউএপিএ-ও দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এসটিএফ সূত্রের খবর, সেই ভাবেই ইউএপিএ-র ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর ধারা প্রয়োগ করা হবে তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ওই বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সরাসরি জড়িত থাকা বা জেনেবুঝে মদত দেওয়া এবং সেই জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ ও সেটা প্রমাণিত হলে শাস্তির পরিমাণের কথা ওই সব ধারায় বলা আছে। সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ন্যূনতম শাস্তি পাঁচ বছরের কারাবাস।

গোয়েন্দারা জানান, শুক্রবার উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এসটিএফের হাতে গ্রেফতার হওয়া আইএসআই এজেন্ট ও পাক নাগরিক ইজাজের কাছ থেকে গার্ডেনরিচের একই পরিবারের তিন জনের নাম পাওয়া যায়। তখন উত্তরপ্রদেশের এসটিএফ অফিসারেরা বিষয়টি কলকাতা পুলিশকে জানান। তদন্তে বেরোয়, ইজাজের এক রকম সাব-এজেন্ট হিসেবে ওই তিন জন কাজ করত।

উত্তরপ্রদেশ পুলি‌শের আইজি (এসটিএফ) সুজিত পাণ্ডে মঙ্গলবার বলেন, ‘‘ইজাজ আমাদের বলেছে, ও শুধু মেরঠ, বরেলী, আগ্রা-সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার সেনা ও বায়ুসেনা ঘাঁটির গোপন নথি পাচার করেছে। কিন্তু তা হলে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪-র ডিসেম্বর— প্রায় দু’বছর ইজাজ কলকাতায় থাকতে গেল কেন? ওখানে পাসপোর্ট, আধার কার্ড করার পর ওর তো সোজা মেরঠে চলে আসার কথা!’’ আইজি বলেন, ‘‘এই জট খুলতেই ইজাজের সঙ্গে গার্ডেনরিচের ওই তিন জনকে এক সঙ্গে বসিয়ে জেরা করা দরকার। কলকাতা পুলিশের হেফাজতে ওই তিন জনের মেয়াদ সম্পূর্ণ হওয়ার পর তাদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য আমরা আদালতে আবেদন জানাব।’’

ইউএপিএ প্রয়োগ করা হলে কলকাতা এসটিএফের হেফাজতে তাদের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৩০ দিন।

তবে আসফাকের মামা জাহাঙ্গির সেনাবাহিনীর গোপন নথি পাচার করেছিল বলে এখনও তেমন প্রমাণ মেলেনি। এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, মেরঠে শুক্রবার গ্রেফতার হওয়া পাক নাগরিক তথা আইএসআই এজেন্ট ইজাজকে ভারতীয় পাসপোর্ট, আধার কার্ড ও রেশন কার্ড তৈরি করে দিয়েছিল জাহাঙ্গির। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে ইউএপিএ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তা নিয়ে তদন্তকারীদের একাংশ ধন্দে।

রাজ্যের মসনদে বসতে পারলে ওই আইনকে পশ্চিমবঙ্গে তিনি আর প্রয়োগ করতে দেবেন না বলে ২০১১-র বিধানসভা ভোটের প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই কথা না রাখায় বিশিষ্ট জনেদের একাংশ মমতার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু মমতা সে সমালোচনাকে গুরুত্ব দেননি। উল্টে বলেছিলেন, মাওবাদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই ওই কেন্দ্রীয় আইন তৈরি হয়েছে। মমতার আমলে ধৃত মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম ওরফে বিক্রম, অভিষেক মুখোপাধ্যায় ওরফে অরণ্য ও রঞ্জন মুণ্ডা এবং মাওবাদী নেত্রী দেবলীনা চক্রবর্তী ও জয়িতা দাসের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা করেছে রাজ্য সরকার।

এ বার শাসক তৃণমূলের সংগঠনে সরাসরি যুক্ত বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর তা করছে এনআইএ বা সিবিআইয়ের মতো কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা নয়—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই পুলিশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE