মাদকাসক্ত ‘তিলোত্তমা’! — প্রতীকী চিত্র।
একে মাদকে রক্ষা নেই, তাতে যৌনতা দোসর! আর তেমনই সব চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন কলকাতার বিভিন্ন নামী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা!
নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র গোয়েন্দারা সোমবার এমনই এক চক্রের পাণ্ডা-সহ তার একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তে উঠে আসছে আরও সব মারাত্মক তথ্য।
এমনিতে শহরের অভিজাত পার্টিগুলিতে মাদক ব্যবহারের অভিযোগ বেশ কয়েক বছর ধরেই উঠছে। সেখানে এলএসডি, এমডিএমএ-র মতো মাদকের বহুল ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। কিন্তু, সেই মাদক সরবরাহের পাশাপাশি এই চক্রটি শহরের বিভিন্ন জায়গায় নাকি ‘এসকর্ট সার্ভিস’-এর ব্যবসাও নাকি করত। জেরায় সে কথা স্বীকার করে নিয়েছে অভিযুক্তরা।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তাঁদের জালে ধরা পড়েছেন দিব্যেন্দু রায় নামে এক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। সঙ্গে তাঁর সঙ্গী প্রশান্ত বাসনেট-ও। গোয়েন্দাদের দাবি, দিব্যেন্দুই ছিলেন এই চক্রের মাথা।আশ্চর্যের আরও বাকি ছিল। ধৃতদের মধ্যে দুই তরুণীও রয়েছেন। তাঁরা কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রাক্তনী।বেঙ্গালুরু থেকে এই শহরে এলএসডি, এমডিএমএ-র মতো পার্টি ড্রাগ আমদানি করতেন দিব্যেন্দু। ধৃতদের কাছ থেকে ১৯টি এলএসডি ব্লট এবং আড়াই কিলোগ্রাম গাঁজা উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের জেরা করে জানা গিয়েছে, মূলত ধনী পরিবারের ছাত্রছাত্রীরাই এই মাদকের মূল ক্রেতা।ধৃতদের মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে পেশ করা হয়।
দিব্যেন্দু রায় (বাঁ দিক)। সঙ্গে প্রশান্ত বাসনেট-সহ দুই ছাত্রী। — নিজস্ব চিত্র।
শহরের অভিজাত পার্টিতে মাদক পাচারের দায়ে ধৃত মনিকা (নাম পরিবর্তিত)-কে জেরা করে তাজ্জব হয়ে গিয়েছেনএনসিবি-র গোয়েন্দারা। তাঁর বয়স মাত্র ১৯। কিন্তু, মাসে রোজগার কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা!মনিকাকে জেরা করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, অভিজাত পার্টিতে মাদকের মৌতাতের সঙ্গে যৌনতার পসরাও পৌঁছে দিতেনতিনি। খালি কলকাতার অভিজাত পার্টি সার্কল নয়, মনিকার পসরা পৌঁছত দিল্লি, রাঁচী, খড়্গপুরেও। ব্যবসায়ী, শীর্ষ পুলিশকর্তা থেকে শুরু করে মাঝারি মাপের অভিনেতারাও রয়েছেন মনিকার মক্কেলের তালিকায়।
গত কয়েক মাসে শহরে পার্টি ড্রাগ সরবরাহকারী তিনটি আলাদা মডিউলকে গ্রেফতার করেছে এনসিবি। ধৃতদের জেরা করে দীর্ঘ দিন ধরেই গোয়েন্দারা সন্দেহ করছিলেন, শহরের মাদক চক্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে ‘এসকর্ট সার্ভিস’-এর।মনিকা ও তাঁর এক বান্ধবী নাফিসাকে (নাম পরিবর্তিত) গ্রেফতার করে মাদক-এসকর্ট যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
ট্যাংরায় বিবাহবিচ্ছিন্না মা-কে নিয়ে থাকেন মনিকা। এক সময় কলকাতারই একটি নামী স্কুলের ছাত্রী ছিলেনতিনি। সেখানেই আলাপ নাফিসার সঙ্গে। আদতে কাশ্মীরি নাফিসা বড় হয়েছেন বেলগাছিয়াতে। ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ।ধীরে ধীরে বন্ধুদের হাত ধরে মাদকে হাতেখড়ি। বাবা-মা দু’জনেই বিউটি পার্লারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। দু’জনের কাছ থেকেই টাকা পান। তাই পকেটমানির অভাব নেই। এলএসডি, এমডিএম-এর মতো পার্টি ড্রাগ নিতে নিতে ধীরে ধীরে জড়িয়ে যান মাদক ব্যবসায়।
চক্রের হদিশ পেতে নাফিসাকেই টার্গেট করেছিলেন গোয়েন্দারা। তাঁকে ধরেই হদিশ মেলে মনিকার। জেরায় নাফিসার স্বীকারোক্তি, পাঁচতারা হোটেল, আলিপুরের পার্টিতে এসকর্ট হিসেবে যাতায়াত ছিল তাঁর। পরিচিত এই পার্টি সার্কিটেই পৌঁছে দিতেন মাদক। কয়েকটি ডেটিং সাইটের মাধ্যমে নতুন মক্কেলদের কাছেও যেতেনতিনি। আর এই এসকর্টের ব্যবসার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন মনিকা। মাদক বিক্রির লাভের পাশাপাশি এসকর্ট হিসেবে প্রতি রাতে নাফিসার রোজগার ছিল ২০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন: ফ্রিজার-কাণ্ডে অসহযোগিতার অভিযোগ, ব্যাঙ্ককে নোটিস
মনিকা-নাফিসাকে জেরা করে আরও একটি বিষয়ে নিশ্চিত গোয়েন্দারা। কলকাতার বিভিন্ন নামী স্কুল ও কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন কিছু ছাত্রছাত্রী রয়েছে এই মাদক ক্রেতাদের মধ্যে প্রথম সারিতে। এনসিবি-র জোনাল ডিরেক্টর দিলীপ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে জানিয়েছি। সেখানে আমরা কাউন্সেলিং করব।’’
এলএসডি।
ধৃত তরুণীদের কাছ থেকেই হদিশ মেলে চক্রের মূল পাণ্ডা লেকটাউনের বাসিন্দা দিব্যেন্দু রায়ের। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী দিব্যেন্দু বেঙ্গালুরু থেকে এই মাদক আনতেন।এর পর তাঁর সঙ্গী প্রশান্ত বাসনেট এবং বাকিদের মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন বিভিন্ন পার্টিতে। ২০১৫-য় বেঙ্গালুরু থাকাকালীন মাদক পাচার করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন দিব্যেন্দু।
ধৃতদের সকলেরই একটি বিষয়ে মিল আছে। প্রত্যেকেরই বাবা-মা বিবাহবিচ্ছিন্ন। পারিবারিক এই কারণ কি এই তরুণ-তরুণীদের ড্রাগ আর সেক্সের অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে? সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy