Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

টেট-বিভ্রাটে চক্রান্ত দেখছেন বিরোধীরা

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট নিয়ে প্রথম থেকেই নানা সংশয় ছিল বিরোধীদের। এই পরীক্ষায় পাশ করিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট নিয়ে প্রথম থেকেই নানা সংশয় ছিল বিরোধীদের। এই পরীক্ষায় পাশ করিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। এই সংশয়-অভিযোগের বাতাবরণে রাজ্য সরকার যে-কারণ দেখিয়ে পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে টেট পিছিয়ে দিল, তা নিয়েও উঠছে হাজারো প্রশ্ন। এবং সেই সব প্রশ্নবাণই এই পরীক্ষায় দুর্নীতির নালিশ নিয়ে আরও সরব হওয়ার সুযোগ করে দিল বিরোধীদের।

কাল, রবিবার প্রায় ২৩ লক্ষ প্রার্থীর এই পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু বাস থেকে প্রশ্নপত্রের একটি প্যাকেট খোয়া যাওয়ায় টেট স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ৪ অক্টোবর এই পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে শুক্রবার জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

এই নিয়ে তৃণমূল আমলে সরকারি পর্যায়ে নেওয়া দু’-দু’টি পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হল ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির জন্য। গত জুনেই আইটিআই-এর প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি-কে। তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সাত জনকে গ্রেফতার করলেও মূল অভিযুক্তকে এখনও ধরতে পারেননি। আইটিআই প্রবেশিকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো টেটের ক্ষেত্রেও বড় চক্রান্তের ছায়া দেখছে বিরোধী শিবির।

কী ভাবে টেটের প্রশ্নপত্র খোয়া গেল, তা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না এই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকদের একাংশের। পার্থবাবু এ দিন বলেন, ‘‘ডাক বিভাগের একটি বাসে ১৫৪টি প্রশ্নপত্রের প্যাকেট পাঠানো হচ্ছিল হুগলির শ্রীরামপুরে। পথে একটি প্যাকেট হারিয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে ডাক বিভাগ। এই পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্যই টেট পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’

বাসে রাখা ১৫৪টি প্যাকেটের মধ্যে মাত্র একটি প্যাকেট কী ভাবে খোয়া গেল, তার জুতসই ব্যাখ্যা কিন্তু ডাক বিভাগ বা রাজ্য সরকার, কেউই দিতে পারেনি। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পরে ডাক বিভাগের দাবি, বাসটির পিছনের একটি ‘ফাইবার গ্লাস’ খোলা ছিল। পথে অনেক ‘হাম্প’ পেরোতে হয় বাসটিকে। সেই ঝাঁকুনিতেই পিছনের ফাইবার গ্লাসটি খুলে গিয়েছিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে। ডাক বিভাগের কর্তারা জানান, ওই খোলা অংশ দিয়ে প্রশ্নপত্রের একটি প্যাকেট রাস্তার কোনও জায়গায় পড়ে গিয়েছে।

রাজ্যের চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল (সিপিএমজি) অরুন্ধতী ঘোষ বলেন, ‘‘ওই বাসে মোট ১৫৪টি সাদা কাপড়ের প্যাকেটে প্রশ্নপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্যাকেটগুলি জল-নিরোধক কাপড়ে তৈরি। তার মধ্যে একটি প্যাকেট পড়ে যায়।’’ ডাক বিভাগের কর্তারা জানান, ঘটনার পর থেকে এ দিন সকাল পর্যন্ত পাঁচ-ছ’বার পুরো রাস্তায় খোঁজখবর চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ভর্তি ব্যাগটির খোঁজ মেলেনি।

ডাক বিভাগের দুই কর্মী ছাড়াও ওই বাসে রাজ্য পুলিশের দু’জন সশস্ত্র কর্মী ছিলেন। তাঁরাও কেন প্রশ্নপত্রের প্যাকেট পড়ে যাওয়ার বিষয়টি দেখতে পেলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাস্তায় ফাইবার গ্লাস খুলে যাওয়া এবং সেই ফাঁক দিয়ে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট পড়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন পুলিশের একাংশ। তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, এর পিছনে অন্য কোনও পরিকল্পনার সম্ভাবনাও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ডাক বিভাগ। পুলিশের কাছেও একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।

তদন্তের তৎপরতার মধ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধী শিবির। প্রশ্নপত্র লোপাটের ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছেন বামপন্থীরা। এই নিয়ে আজ, শনিবার বেলা ১২টা থেকে রাজ্য জুড়ে অবরোধের ডাক দিয়েছে ডিওয়াইএফ। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘সরকার শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমরা বলছি, প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে!’’

বসে নেই কংগ্রেসও। এই ঘটনার দায় নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ইস্তফা দেওয়া উচিত বলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি। সেই দাবিতে সুর মিলিয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগঠন যুব লিগের রাজ্য সম্পাদক আব্দুর রউফও। অধীরবাবুর অভিযোগ, ‘‘টেট নিয়ে যা হচ্ছে, তা ব্যপম কেলেঙ্কারির চেহারা নেবে। প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি তো লুঠ হচ্ছে!’’ আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাকে এই সরকার ‘তামাশা’য় পরিণত করেছে।

বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য প্রশ্নপত্র লোপাটের দায় পুরোপুরি ডাক বিভাগের উপরেই চাপিয়েছেন। পার্থবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যের ৫০১৫টি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ডাক বিভাগের।

ওরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে।’’ ডাক বিভাগের বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

শিক্ষামন্ত্রী ৪ অক্টোবর টেটের নতুন যে-তারিখ ঘোষণা করেছেন, তা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

কী সেই বিতর্ক?

৩ অক্টোবর বিধাননগর-রাজারহাট ও আসানসোল পুর নিগম এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচন রয়েছে। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে সেই ভোট নেওয়া হবে। তার পরের দিনই কী করে সেখানে টেট করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্ত উপাধ্যায়ের বক্তব্য, এতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, ৩ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে তাঁরা স্কুল-কলেজ ছেড়ে দেবেন। তার পরে টেটের প্রস্তুতি চালানো যাবে। তিনি বলেন, ‘‘মাত্র দু’টি পুর নিগমে নির্বাচন হচ্ছে। এতে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’

কিন্তু ডিওয়াইএফের বক্তব্য, এত কম সময়ে ভোটকেন্দ্রগুলিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিণত করতে সমস্যা হতে পারে। তাদের দাবি, পরীক্ষা যখন পিছিয়েই গিয়েছে, তখন ৪ অক্টোবর না-নিয়ে পুজোর পরে তা নেওয়া হোক। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য জানাচ্ছেন, ৪ অক্টোবর টেট শুরু হবে বেলা ২টোয়। তার আগের দিন ভোট থাকলেও সেখানে পরীক্ষা কেন্দ্র প্রস্তুত করতে কোনও সমস্যা হবে না।

তবে পুলিশ মোতায়েনের ক্ষেত্রে ওই সব ভোটকেন্দ্র তথা পরীক্ষা কেন্দ্রে কিছুটা সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের একাংশ। পুর দফতরের অফিসারদের একাংশও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা মনে করছেন, টেটের নতুন দিন ঘোষণার আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল শিক্ষা দফতরের। এখনও সেই সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন পুর দফতরের ওই আধিকারিকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE