অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মোহনবাগান সবে ফেড কাপ জিতেছে। সন্ধ্যেয় কৃষ্ণনগরের পোস্ট অফিস মোড় সরগরম। তার মধ্যেই পিড়িং পিড়িং। খানিক বাদে-বাদেই বুকপকেটে জ্বলে উঠছে নরম জ্যোৎস্না। এর, ওর তার। আর পিড়িং... গলা ফাটাতে-ফাটাতেই ঝাঁ করে পকেটে আঙুল গলিয়ে এক বার তুলে আনতে হচ্ছে নরম আলোয় উদ্ভাসিত মোবাইল। আড়চোখে দেখেও নিতে হচ্ছে...
Sridhar
ki re, kemon dilam?
Moinak
যা ফোট, এক মাঘে শীত যায় না
Mouli
toder ar kono katha nei esob chara? Chol na dudin Digha theke ghure asi…
প্যাঁক করে হর্ন দিয়ে একটা রিকশা গায়ের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর একটু হলেই কেলেঙ্কারি হত।
—এই, তোরা দশটা মিনিট মোবাইল না দেখে থাকতে পারিস না? জ্যান্ত মানুষগুলো সামনে বসে সে দিকে নজর নেই, সারাক্ষণ খালি হোয়াটসঅ্যাপে বকবক!
প্রায় ধমকে উঠলেন দানেশ কাকা। রিটায়ার করেছেন কয়েক মাস হল। মোবাইল একটা আছে ঠিকই। কিন্তু ঠিক বাগে আনতে পারেন না। হুবহু ল্যান্ডলাইনের কায়দায় ডায়েরি থেকে নম্বর দেখে ডায়াল করেন। স্মার্টফোন দেখলে তিনি ঘাবড়েই যান। আর, হোয়াটসঅ্যাপে কাউকে ঘাড় গুঁজতে দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে যান।
কিন্তু দানেশকাকারা এখন প্রায় বিলীয়মাণ ডাইনোসর। ক’দিন পরে মিউজিয়ামে ঠাঁই হবে। মুখের উপরে কথা না বললেও তোয়াক্কাও করে না কেউ। স্ক্রিনে বাজতে থাকে পিড়িং:
Rima
ei jano, aj tuktukir boy friend-ke dekhlam! danrao tomay chobi pathacchi…
পাড়ার মাচায় আড্ডা দিতে-দিতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় ছেলে, ঠোঁটের কোণে খেলে যায় হালকা হাসি। তার পরেই সামলে নিয়ে বলে— হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম...
আসলে আড্ডা একটা তো নয়। মাচার ওই আড্ডার মধ্যে আসলে এক সঙ্গে অনেকগুলো আড্ডা চলছে। এক জনের মোবাইলে স্কুলবেলার বন্ধুদের সঙ্গে একটা, অফিস কলিগদের সঙ্গে একটা, বান্ধবীর সঙ্গে একটা..। পাশের মোবাইলে ‘মিঠুন ফ্যান ক্লাব’ আর ‘আমার অরণ্য ফিরিয়ে দাও’। তার পাশে ‘পাগলা জগাই’ আর ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ আর ‘বহরমপুর কেএন কলেজ ২০০৬ ব্যাচ’... গ্রুপে গ্রুপে ছয়লাপ। কত কথা, চলছে তো চলছেই। হোক কলরব!
কল্যাণী স্টেশন থেকে কয়েক কদম দূরেই গাছগাছালি ভরা পার্ক। বছর দেড়েক আগেও সকাল থেকে ভিড় লেগে থাকত। বয়সের বাছবিচার নেই। কমবয়েসীই বেশি। সেই পার্কের বেঞ্চিগুলোয় এখন ধুলো জমছে। বিকেলে কয়েক জন বৃদ্ধ এসে বসেন। বাকি ভিড়টা সরে গিয়েছে পার্ক থেকে খানিক দূরে একটি রেস্তোরাঁ চত্বরে। সেখানটা যে ‘ফ্রি ওয়াই ফাই জোন’! ছেলেছোকরার দল অতএব সেখানেই সেঁদিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। নজর মোবাইলে। কল্যাণী ২ নম্বর বাজারের চায়ের দোকানে নিত্য আড্ডাধারী গৌতমব্রত গোস্বামী বলেন, ‘‘এখন সবাই নাকি আড্ডা দিচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে। কথা বলব আর কার সঙ্গে?’’
বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজের ক্যান্টিনে আর সেই আগের মতো টেবিল বাজিয়ে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা... ’ গাওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। তার বদলে মোবাইলের গান, সে-ও হোয়াটসঅ্যাপে ‘শেয়ার’ হয়ে আসা। বিয়েবাড়ির ছাদনাতলায় কনে বসে মাথা নিচু করে। এক জন বলে উঠলেন, ‘‘বড্ড লাজুক! মুখটিও তুলছে না।’’ পাশ থেকে ফিসফিস—‘‘না না, হোয়াটসঅ্যাপ করছে!’’
লালগোলা হাইস্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক জাহাঙ্গির মিঞা স্ত্রী শামিমার চিকিৎসার জন্য আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছেন। কিন্তু আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখই ফেরাতে পারছেন না। সময়ে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার কথাও ভুলে মেরে দিয়েছেন। শামিমার অনুযোগ, ‘‘সারা ট্রেনেও তো এসেছে মোবাইলে মুখ গুঁজে!’’ সমাজকর্মী উত্তম জৈন বলেন, ‘‘আগে আমরা বন্ধুরা এমএন অ্যাকাডেমি মাঠে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতাম। এখনও আমরা বিকালে গোল হয়ে বসি। কিন্তু সবাই যেন বোবা! স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত। বাড়ি ফেরার সময় খালি কথা ফোটে— ‘‘দেরি হয়ে গেল খুব, চলি রে!’’
গরমের সন্ধ্যেয় ভিড় জমতে থাকে করিমপুরের রেগুলেটেড মার্কেট মাঠে। ফুরফুরে হাওয়ায় হাসি-আড্ডায় ক্লান্তি জুড়োয়। কিন্তু এখন ছবিটাই বদলে গিয়েছে। লোডশেডিং হলে মনে হয় মাঠ ভরে গিয়েছে জোনাকির আলোয়। আড্ডাধারী সুজিত বিশ্বাসের কথায়, “আগে কেউ ফুটবল খেলত, কেউ বা মাঠের চারপাশে দৌড়ত। এখন তো সব মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত!’’ পঞ্চাশোর্ধ্ব অম্বিকা বিশ্বাসের খেদ, “চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গিয়েছে।’’
স্কুলশিক্ষক বিকাশ সরকার বলেন, ‘‘অফ পিরিয়ডে এখন কেউ আর গল্প করে না। স্টাফরুমে বসেই দুনিয়া জো়ড়া বন্ধু সামলায়।’’ ডোমকলের শিক্ষক সানোয়ার হোসেনের একই অভিজ্ঞতা, “গোটা স্টাফরুমই এখন ইন্টারনেটের দখলে। যে ক’জন বয়স্ক শিক্ষক, তাঁরা গল্প করলেও নতুন প্রজন্মের শিক্ষকেরা মোবাইলে মজে থাকেন।’’ ক্লাসে গিয়েও কেউ-কেউ পড়ুয়াদের আঁক কষতে দিয়ে টুক করে এক বার হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে নিচ্ছেন, এমন ছবিও আকছার।
বাংলাদেশ ঘেঁষা চরমেঘনার চাষি সুশান্ত মণ্ডল থেকে নবদ্বীপের বাবাজি — সকলেই টের পাচ্ছেন বদল। রঘুনাথগঞ্জ সদরঘাটেও আর কোনও হইচই নেই। সামনে ভাগীরথী। আর, হাতে-হাতে মোবাইল। কলেজছাত্র রাকেশ সরকার সোজাসুজি বলেই দেন, “হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া আমি তো একটা দিনও ভাবতে পারি না!’’
সন্ধ্যে নেমেছে।
মহসিনের চায়ের দোকানে টিভিতে সিনেমা চলছে। এক বিধায়ককে ধরে পেটাচ্ছে পুলিশ অফিসার প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। গোগ্রাসে গিলছে পনেরো জোড়া চোখ। কিন্তু আজ প্রিয়াঙ্কাতেও মন নেই রমজানের। কে যেন খালি টোকা দিয়ে চলেছে তার বুকপকেট আলো করে।
এ এক অন্য জ্যোৎস্না...!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy