Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জানি বর্ষা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে

বলতে বলতে থেমে গেল এতক্ষণের কথার তোড়। হঠাৎ নীরবতা। চোখও একেবারে ছলছল। সঙ্গী ফোটোগ্রাফার বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে কোন দায় মেটাবে? মানবিক? না পেশাদার? দেড় মিনিটের নিস্তব্ধতা হোটেলে পাঁচতলার স্যুইটে। মুহূর্তেই আবার কন্যাহারা মর্মান্তিক বাস্তবতাকে হারিয়ে তিনি স্থানান্তরিত লৌহমানবী আশা ভোঁসলে-তে। মুখোমুখি এক ঘণ্টারও বেশি কাটিয়ে ফেরা গৌতম ভট্টাচার্য‌-র মনে হল অসম্ভব লড়াকু আর জৌলুসে ভরা একটা ফিল্ম দেখে বেরোলেন!কাল রাত্তিরে মুম্বইতে শুনলাম তিন ঘণ্টা শো করেছেন। হ্যাঁ, শুধু গাইনি। প্রচুর নেচেওছি। বলেন কি? হ্যাঁ, ‘আ দেখে জারা...’ ধরতেই তুমুল নাচ শুরু হয়ে গেল। আমিও নাচতে শুরু করে দিলাম। তারপর রাত্তিরে বাড়ি ফিরে ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। দু’টো নাগাদ ঘুমোতে গিয়েছি। পাঁচটায় উঠে ফ্লাইট ধরলাম। প্লেনেও ঘুমোইনি। এয়ারহোস্টেস একটা মরাঠি বই এনে দিল। সেটা পড়ছিলাম। তারপর কলকাতায় পৌঁছে চান-টান করে খেয়েদেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে আপনার ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

ছবি: কৌশিক সরকার।

ছবি: কৌশিক সরকার।

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কাল রাত্তিরে মুম্বইতে শুনলাম তিন ঘণ্টা শো করেছেন।

হ্যাঁ, শুধু গাইনি। প্রচুর নেচেওছি।

বলেন কি?

হ্যাঁ, ‘আ দেখে জারা...’ ধরতেই তুমুল নাচ শুরু হয়ে গেল। আমিও নাচতে শুরু করে দিলাম। তারপর রাত্তিরে বাড়ি ফিরে ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। দু’টো নাগাদ ঘুমোতে গিয়েছি। পাঁচটায় উঠে ফ্লাইট ধরলাম। প্লেনেও ঘুমোইনি। এয়ারহোস্টেস একটা মরাঠি বই এনে দিল। সেটা পড়ছিলাম। তারপর কলকাতায় পৌঁছে চান-টান করে খেয়েদেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে আপনার ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

শুনলাম রোম যাচ্ছেন?

যাচ্ছি। আবার আমাকে ম্যাঞ্চেস্টারও যেতে হবে। আমার রেস্তোরাঁর উদ্বোধন রয়েছে। এই নিয়ে ‘আশাজ’-য়ের দশটা রেস্তোরাঁ হবে পৃথিবী জুড়ে।

নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সেদিন আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন।

আশা ভোঁসলে রাজ্যসভা যাচ্ছেন জাতীয় অ্যানাউন্সমেন্ট কি আমরা শিগ্গির পাচ্ছি?

না, না। আমি গিয়েছিলাম সৌজন্য সাক্ষাৎকারে। ওঁকে মুখোমুখি বসে অভিনন্দন জানাতে। আমি মনে করি না ওই টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম কী ফুল চলে গেল আমার তরফে তাতে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখানো হয়। যদি সত্যি কাউকে মন থেকে কনগ্র্যাচুলেট করতে হয় তো সামনে গিয়ে বলো। মোদীজি আমার একটা গুজরাতি সিডি-র উদ্বোধনও করেছিলেন। তখন অবশ্য উনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। এ বারও আমায় বললেন যে, ‘আপনি বলুন না, নতুন দায়িত্বে তো কী। আবার রিলিজ করে দিচ্ছি।’

একাশি প্লাস আপনি এখন। এ ভাবেই দৌড়ে যাবেন?

হ্যাঁ। যব তক হ্যায় জান?

যব তক হ্যায় জান?

আরে বাবা আমায় তো করাত দিয়ে কিছু কাটতে হচ্ছে না। পাথর দিয়ে জিনিসপত্র ভাঙতে হচ্ছে না। নিজের গলাটাকে ব্যবহার করে গান গাইছি। এই তো!

আপনি একই সঙ্গে সফল মা। পুরোদস্তুর সংসারী এক মহিলা। কিংবদন্তি গায়িকা। আবার আন্ডারডগ থেকে চ্যাম্পিয়নও। ভবিষ্যতে কোন ভূমিকায় চান মানুষ আপনাকে মনে রাখুক?

(হাসি) মনে রাখুক সেই মহিলাকে যে সৎ মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ থেকে কখনও পালিয়ে যায়নি। যে কাজ পেলেই এনার্জি পেয়ে গেছে। যে মঞ্চে পারফর্ম করেই বসে থাকেনি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে। যে নিজে রান্না করেছ। যে পরিবারের সবাইকে দেখেছে। যে কর্তব্য সামনে দেখলেই নতুন এনার্জিতে ভরপুর হতে পেরেছে।

এনার্জির এই অফুরন্ত ট্যাপটা কোথায় লুকোনো বলবেন? ওটার তলায় একটু গিয়ে দাঁড়াব!

হা হা, কখনও ভাবিনি। ফাংশনের পর কাল রাতেই আমার বৌমা বলছিল, ‘হচ্ছেটা কী! সাড়ে তিন ঘণ্টা শো করেছ তুমি! আমাদেরই তো লজ্জায় ফেলে দিচ্ছ। তোমার অর্ধেক বয়স আমার।’

আমাদের দেশে ষাট হতে না হতেই বেশির ভাগ মানুষ খুব মনমরা হয়ে পড়ে। অবসর জীবনে তারা ডিপ্রেশনে ভোগে। এই সিক্সটি প্লাসদের উদ্দেশে আপনার একাশি বছর কী টিপস দেবে?

এটাই বলব যে, চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন মানে জীবন থেকে সন্ন্যাস নেবেন না। যত দিন বাঁচবেন কাজ করে বাঁচুন। অনেক আরাম পাবেন। অনেককে দেখেছি রিটায়ারমেন্টের আগেই প্ল্যানিং করছে, আহা দুপুরে আরামে ঘুমোতে পারব। আমার কাছে সেটা আলসেমি। আমি অসুস্থ না হলে জীবনে দুপুরে ঘুমাইনি। আমাকে যদি জবরদস্তি শুইয়ে দেওয়া হয়, অন্য কথা। নইলে আমি একটা কিছু শুরু করে দেব। হাতে কিছু না থাকলে ঘর সাফাই। চুপ করে বসা আমার নসিবে নেই। আমি রিটায়ারমেন্টের পর অনেককে দেখেছি জাস্ট বসে বসে খাচ্ছে আর রেস্ট নিচ্ছে। এদের শরীর কিছু দিন বাদেই কোনও ফিজিক্যাল নাড়াচাড়া ছাড়া খারাপ হয়ে যায়। আমার সাফ কথা হল, ভাই জীবনে থাকতে হলে সামনে তাকাতে হবে। দৌড়তে হবে। কীসের অবসর? শব্দটাই আমার কাছে অরুচির। আমি বলব অবসরের আগে মনে মনে ছকে নিন এবার নতুন নতুন কী কাজ করবেন।

জীবনের শেষ দিকে দেব আনন্দকে একবার একটা ইন্টারভিউ করেছিলাম। মনে হচ্ছে অবিকল সেই কথাগুলো আপনার মুখে শুনছি।

আরে দেবসাব তো আমার গুরু! আমি পুরোপুরি ওঁকে ফলো করেছি। আমি ওঁকে সব সময় খেপাতাম, কী নতুন নতুন হিরোইন খুঁজে বেড়াচ্ছেন? আমার দিকে একটু তাকান না। আর উনি লজ্জিত ভাবে বলতেন, ‘সোচতা হুঁ, সোচতা হু।ঁ’ একবার খুব এক্সাইটেড ভাবে বললেন, ‘এই ছবির জন্য গলাটাকে একেবারে ষোলো বছর করে ফেলুন।’ আমি বললাম, করে আনব মানে? আমার বয়স তো ষোলোই! আপনি শুধু আমায় রোলটা দিন না। হা হা। দেবসাবকে দেখে আমি শিখেছি, জীবন কী ভাবে চালাতে হয়। শিখেছি যত দিন জিন্দা আছ, খাড়া থাকো।

আশাজি, আপনার ঘনিষ্ঠরা কেউ কেউ বলেন একটা গান আছে যেটা দিয়ে আপনাকে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করা যায়।

সেটা কী (খুব বিস্মিত)!

‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা...’

‘কল ক্যয়া হো কিসনে জানা’। ঠিকই। জীবনটা এ রকমই। আর একটা গান আছে আমার সঙ্গে খুব যায়। শাহির লুধিয়ানভির লেখা ‘আগে ভি জানে না তু, পিছে ভি জানে না তু’। তুমি আগে কী হয়েছে জানো না, পরে কী হবে তাও জানো না। তা হলে এত ভেবে কী করবে।

ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম বিদেশে খেলতে যাওয়ার আগে আপনাকে তো মোটিভেটর করে পাঠানো উচিত!

হা হা! আমি তো ক্রিকেট খুব ভালবাসি। ইন্ডিয়ান টিমের অনেকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। বিশেষ করে সচিনকে আমি ভীষণ ভালবাসি। ওর বৌটাও খুব সুইট। সচিনকে আমি বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, ‘কেন তুমি রিটায়ার করবে? এটা রিটায়ারমেন্টের কোনও সময় হল!’ ও বলল, হাতে নাকি কী চোট আছে, আরও খেললে হাতের জোর কমে যাবে। আমি তাতেও নিরস্ত হইনি। বলেছিলাম, ‘একেবারে ছাড়বে কেন? পৃথিবীব্যাপী এত লোক তোমায় দেখতে চায়। ক্রিকেট তোমার হার্টে আছে। পুরো ছেড়ো না। একটু বেছে বেছে খেলো। একেবারে চলে যাবে, এ কি হয় নাকি? সারা পৃথিবীতে তোমার ফ্যানরা ভীষণ ভেঙে পড়বে।’

আপনার এই বয়সেও যে এত উদ্যম শরীরজনিত সমস্যা-টমস্যা নেই? ব্লাড প্রেশার ঠিকঠাক?

প্রেশার ঠিক আছে। সুগার নেই। কোলেস্টেরল নেই। হিমোগ্লোবিনটা একটু কম আছে। মাঝেমাঝে সেটা বেশ গড়বড় করে। তো কী করব! সেটা নিয়েই লড়ছি।

বলিউডে অনেকে মনে করে, রাজেশ খন্নার মধ্যে এমন শৃঙ্খলা থাকলে তাঁকে অমিতাভের কাছে রাজ্যপাট খোয়াতে হত না।

স্টারদের আসলে চেহারা ঠিক রাখাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। একটু বয়স হয়ে গেল। মুখের মাংস-টাংস ঝুলে গেল কী তুমি শেষ। আমার নাতনি ভাল গায়। কিন্তু ও ফিল্মে অভিনয় করার জন্য খুব উদ্গ্রীব। আমি সে দিন ওকে বকলাম, ‘খবরদার হিরোইন হতে যাস না। তা হলে পঁচিশেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমাকে দ্যাখ। গায়িকা হয়ে যা, আশি বছরেও টানতে পারবি!’ অনেকে আমায় জিজ্ঞেস করে, আশাজি আপনি ফিল্ম করেননি কেন? আমি উত্তর দিই, ভাই, ফিল্ম করলে এই বয়সে কি খোঁজখবর নিতেন? নাকি আমার শো দেখতে আসতেন?

দুনিয়া জুড়ে এত শো করেন। অথচ প্লে ব্যাক করতে আজকাল আপনাকে দেখাই যায় না।

আজকাল প্লে ব্যাক বলে কিছু আছে নাকি? গানটা হয় কোথায়? গোটা ফিল্মে দেড়খানা গান থাকে। তার একটা গায় মিউজিক ডিরেক্টর নিজে। একটা কোনও আইটেম নম্বর, যেটা কোনও মহিলা গায়। আগে কত রকম ভাবনার গান হত। মন্দিরে বসে গান, মায়ের গান, প্রেমের গান, বিরহের গান। সে সব কোথায় হয়?

আরডি বর্মনকে এই সময়ে খুব মিস করেন?

অবশ্যই।

দু’জনের সঙ্গেই আপনি কাজ করেছেন। আরডি বনাম রহমান। কাকে এগিয়ে রাখবেন?

(কিছুক্ষণ নীরব) আপনার প্রশ্নটা কী রকম জানেন? লতা ভাল, না এখন যে সব মেয়ে গাইছে তারা ভাল? কোনও তুলনাই হয় না। কোনও প্রশ্নই হয় না। এখনও গোটা ইন্ডাস্ট্রি পঞ্চমের ভিশনের উপর বসে খাচ্ছে। ওরই সব মডেল এদিক ওদিক করে চালিয়ে দিচ্ছে।

অথচ সেই সময় তো ওঁর খুব সমালোচনা হত।

সে তো নতুন কিছু শুরু করলে সমালোচনা হবেই। আমি যখন ‘ইনা মিনা ডিকা’ প্রথম গাই, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ক্ষুব্ধ হয়ে আমার গান বন্ধ করে দিয়েছিল। পঞ্চমের বেলাতেও তাই হয়েছিল।

আপনি এত সব সুরকার দেখেছেন। খৈয়ম, ওপি নায়ার, কল্যাণজি-আনন্দজি, শঙ্কর-জয়কিষন, শচীন দেব বর্মন। আরডি কি এঁদের মধ্যে গ্রেটেস্ট?

অবশ্যই। এসেই ও সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ‘জুয়েল থিফ’য়ে বাবার সঙ্গে বসে ও যখন গান তৈরি করত, দেখার মতো ছিল। নতুন অর্কেস্ট্রা এনেছিল ও। তার সঙ্গে নতুন রিদম। পঞ্চমের নেশাই ছিল নতুন সাউন্ড বের করা। ‘ডিরা ডিরা ডিরা...’। কী নতুন সব আওয়াজ। ‘তিসরি মনজিল’য়ে তো ইতিহাস তৈরি করল। প্রথম সিন্থেসাইজার ওর কাছেই দেখি। তাও তো আজকের মতো আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট পায়নি। আমার সঙ্গে বসে ‘আজা আজা ম্যায় হু প্যায়ার তেরা’ যখন প্রথম বোঝাল আমার তো হৃৎপিণ্ড দিয়ে হাওয়া বইছিল। কী করে তুলব এই গান? অথচ বাচ্চা ছেলেটার সামনে নার্ভাসনেসও প্রকাশ করতে পারছি না। আজ সত্যি বসে মনে হয়, গানের দুনিয়ায় ও নিঃশব্দে বিপ্লব এনেছিল। আজকেও দেখুন না, আরডি-র গান ছাড়া কোনও কনসার্ট জমে না। কালকেও তো! শুরুতে ‘ও মেরি রাজা’ গাইলাম। তারপর ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মওসম’। ক্রাউড ঠিকঠাক।

‘আ দেখে জারা’ শুরু করতেই সব হাত উপরে উঠে গেল। এর পর যখন ‘একবার জানে জানা’ গাইছি, কেউ আর সিটে বসে নেই। এটাই আরডি ম্যাজিক।

আরডি মারা গিয়েছেন কুড়ি বছরেরও বেশি। কখনও ওঁকে স্বপ্নে দেখেছেন?

দেখেছি (কিছুক্ষণ চুপ)। বেশ কয়েকবার। তবে সবচেয়ে জাগ্রত দেখাটা ওর মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে। দেখি ও এসে আমার হাতটা ধরল। তারপর হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্ধকারে চলে গেল। আমার মনটা তখনই কু ডেকেছিল। আমার ভাইকে বললাম, কিছু একটা খারাপ হবে। আমি এগুলো টের পাই। এর দিন পনেরো বাদে পঞ্চম মারা গেল।

এত সব উথালপাথালের মধ্যে নিজেকে ঠিক রাখার মন্ত্র কী?

মন্ত্র হল, নিজেকে বোঝানো সবার জীবনে খারাপ দিন আসে। ভাল দিন আসে। নিজের মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, খারাপ দিনে যতই ঝোড়ো হাওয়া দিক নিজের জায়গা থেকে হিলব না। নিজের মেহনত থেকে সরব না। একদিন না একদিন সময় ফিরবেই।

মাসখানেক আগে একটা ছবি দেখলাম। পুণের অনুষ্ঠানে আপনাকে সম্মানিত করছেন স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর।

হ্যাঁ (হাসি)। এই সব দিনগুলোর জন্যই তো অপেক্ষায় থাকা।

ওটাই কি আপনার জীবনের গ্রেটেস্ট মোমেন্ট? চিরন্তন আন্ডারডগের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চূড়ান্ত স্বীকৃতি?

অসম্ভব সুখের দিন। কারণ এই প্রথম দিদি বলল, খুব গর্ব বোধ হচ্ছে আমার বোনের জন্য। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে করে চলে গিয়েছিল। অসম্ভব দারিদ্র দেখেছে। চূড়ান্ত অসহায়তার মধ্যে লড়াই করেছে। কিন্তু কোনও দিন আমি বা আমার ভাইদের কাছে চারআনা পয়সাও হাত পেতে নেয়নি। নিজের মেহনতের উপর বিশ্বাস করে থেকেছে।

আপনার লতাদিদি নন, গায়িকা লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে আপনার রেটিং কী?

দিদির মতো গায়িকা আর কোনও সেঞ্চুরিতে হবে কিনা জানি না। আমার তো মনে হয়, আমরা যারা যারা লতা মঙ্গেশকরকে গান গাইতে দেখেছি, তাদের প্রত্যেকের গর্ব হওয়া উচিত একটা অসামান্য ইতিহাসের সাক্ষী থাকার জন্য।

আপনাকে যদি ক্রিকেটের টার্মসে জিজ্ঞেস করি আপনি কোথায় আর লতা কোথায় কী বলবেন? ভিভ আর গাওস্কর?

আরে উত্তর তো পঞ্চম দিয়ে গিয়েছে। দিদিকে বলেছে ব্র্যাডম্যান। আমাকে সোবার্স। (প্রচণ্ড হাসি)

সোবার্স কেন?

মনে হয় আমার ভ্যারাইটি দেওয়ার ক্ষমতার কথা ভেবে (হাসি)।

এই যে প্লে ব্যাক দুনিয়ায় বহুকালীন ‘কমন’ অসন্তোষ আছে, লতা-আশা থাকায় আমারা উপরে উঠতে পারিনি। এটা কতটা সত্যি?

পুরো সত্যি। আমরা এত ভাল গেয়েছি। এত নিয়মনিষ্ঠ থেকেছি। টাইমে এসেছি। টাইমে গিয়েছি। লতা প্রেমের গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আশা চঞ্চল গানে। রিপ্লেসমেন্ট খোঁজার প্রয়োজনই বোধ করেনি সুরকাররা। আর ভাই, জীবনে কি কেউ কাউকে জোরজবরদস্তি আটকে রাখতে পারে। হয় কখনও।

মিউজিক ডিরেক্টর কখনও আমার কথা শুনবে, যদি আমাকে দিয়ে তার কাজ না হয়?

অনেকে কিন্তু এটা বলেন যে, তাঁদের সুযোগ না-পাওয়ার পিছনে বোনেদের রাজনীতি কাজ করেছে! ওই কথাটা শুনেছেন, ‘হাতি চলে বাজার, অউর কুত্তে ভোকে হাজার’? কে কী বলছে সে সব নিয়ে কোনও দিন ধ্যান দিইনি।

কিন্তু এই যে লতাজি অঘোষিত এক। আর আপনি অলিখিত দুই। এই ভাগটা আপনাকে কষ্ট দেয়নি?

গুলজার সবচেয়ে ভাল বলেছিলেন।

কী বলেছেন?

বলেছিলেন, ‘চাঁদে দু’টো লোক একই সঙ্গে নামল। তুমি যে প্রথম পা দিল তাকে নিয়ে এমন নাচানাচি শুরু করলে যে অন্য লোকটার কথা ভুলেই গেলে। আরে সেও তো ভাই চাঁদে একই সঙ্গে গিয়েছে।’

জীবনে দ্বিতীয়জনের সব সময়ই সমস্যা।

আমায় বলুন, নিজের জন্মের উপর তো কারও নিজের হাত থাকে না। কেউ চার বছর পরে এল মানেই সে দুই হয়ে গেল এটা কেমন কথা! আজীবন আমি দু’নম্বরের কাঠগড়াতেই থেকে যাচ্ছিলাম। যার উপর আমার কোনও হাতই নেই। তারপর অবশ্য ঈশ্বরই এক নম্বর করে দিলেন।

ধারণাটা ভেঙে দিলেন কী করে?

মেহনত দিয়ে। আর বুদ্ধি খাটিয়ে। রিওয়াজের স্টাইল বদলালাম। গায়কিতে পরিবর্তন আনলাম। পোশাকের ধরন বদলালাম। আমার নিজস্ব স্টাইল এমন তৈরি করলাম যাতে কেউ বলতে না পারে এ দিদির পরে সেকেন্ড লতা।

আপনার ছেলে আনন্দের মুখে শোনা যে, আপনি বাড়িতে খুব পুজোআচ্চা করেন। আর পুজোর সময় ব্রাক্ষ্মণরা যে শ্লোক পড়েন তার থেকে সঙ্গীতের সোর্স খুঁজে পান। নতুন সুর পান। সত্যি এটা?

ওহ্, আনন্দ বলেছে বুঝি (হাসি)! ব্রাক্ষ্মণরা যখন একসুরে মন্ত্র পড়েন তার মধ্যে একটা অদ্ভুত সুরক্ষেপণ থাকে। এর পর আরও ব্রাক্ষ্মণ যোগ দিলে আশীর্বাদের সময় শিবমন্ত্রটা আরও উঁচু সুরে তুলে দেওয়া হয়। সেই ওঠানামার মধ্যে আমি সুর খুঁজে পাই। আর সেটাকে পাকড়াও করি। আসলে দুনিয়ার যে কোনও জায়গায় শ্রুতিমধুর কিছু পাওয়া গেলেই সেটা পাকড়াও করে নিই। কোনও সুর ছাড়া চলবে না। (হাসি)

এরই মধ্যে আশা লক্ষ করছেন আনন্দplus-এর ফোটোগ্রাফার ক্রমাগত তাঁর ছবি তুলে চলেছেন। কৌশিক সরকারকে হাত নেড়ে ডাকলেন। “আরে ভাই এত ছবি তুলে কী লাভ? বেরোবে তো একখানা কী দেড়খানা।” তার পর নিজেই হাসতে থাকেন। “সে দিন মুম্বইয়ে এক ফোটোগ্রাফার এ রকম ছবি তুলে যাচ্ছে। আমি বললাম, কীরে ভাই এত ছবি দিয়ে কী হবে? ছাপবে তো সেই একটা।” সে অবিচলিত ভাবে বলল, ‘আশাজি স্টক করে রাখছি পরের জন্য।’ বোঝো ঠ্যালা! কবে মারা যাব, তার জন্য স্টক করছে এখন থেকে। হা হা হা।”

আশাজি, আপনি শুধু ভয়ঙ্কর জীবনসংগ্রামে খাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করা একজনই নন। মর্মান্তিক কন্যাশোককেও আপনি জয় করেছেন। লড়াই করতে অনেকেই পারে, কিন্তু এত বয়সে সন্তানের মৃত্যুতে ছারখার হয়ে যায়।

আপনি সেটাও সামলে হাসিমুখে দেশবিদেশ ঘুরছেন।

(ফের নিঃশব্দ। চোখের সতেজ ভাব উধাও) কীসের হাসিমুখ। ভেতরে আজও রক্ত ঝরে। মনে হয় আমার একটা হাত, একটা পা কেউ বুঝি কেটে নিয়েছে।

বর্ষা মারা যাওয়ার পর থেকে কি আপনি মুম্বইয়ের বাইরে অনুষ্ঠান আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন?

(আশা তখন ঠিক শোনার অবস্থায় নেই) কাকে কষ্ট দেখাব? কাকে কী বলব? কে বুঝবে? মেয়ে তো গিয়েছে আমার! ছেলে-বৌ-নাতনি-বন্ধু কে বুঝবে আমার ভেতরকার জ্বালাটা কী? মেরা দুখ, মেরা হ্যায়। আমার নীতি হল, সবাইকে জখম দেখিয়ে লাভ নেই। তারা এর গভীরতা বুঝতেই পারবে না। তার চেয়ে বাথরুমে গিয়ে কেঁদে ভাসাও। যত চেঁচিয়ে পারো কাঁদো। তার পর বেরোও হাসিমুখে।

আপনি এত মানুষের জীবনে অফুরন্ত মোটিভেশন অথচ আপনার মেয়েই কি না চূড়ান্ত অবসাদে এ রকম কিছু ঘটালেন। ভাবাই যায় না।

কী বলব। ও বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল আমার। আমার গার্ডিয়ানও। মা-মেয়েতে প্রচণ্ড তর্কাতর্কিও সময়ে সময়ে হয়েছে। যেমন সব বাড়িতে হয়ে থাকে। কিন্তু দারুণ ভাবও ছিল। মা-মেয়ের একটা স্পেশাল রিলেশনশিপ থাকে। যেটা মা-ছেলেতে হওয়া সম্ভব নয়। আমাকে বর্ষা রীতিমতো শাসন করত। ‘মটন খাও। মিল্ক প্রোডাক্ট খাও। তোমার না

হিমোগ্লোবিন কম’। বলত, ‘রেওয়াজে বসো’। কেন এমন হল জানি না। নিশ্চয়ই আগের জন্মে কোনও পাপ করেছিলাম যে আমার সেরা সম্পদকে হারালাম।

আপনি পূর্বজন্মে বিশ্বাস করেন?

ভীষণ ভাবে।

তাই?

জানি না দুম করে কথাগুলো বলে ফেলছি কেন? বর্ষা নিয়ে কখনও কোনও ইন্টারভিউয়ে কথা বলি না। এটা আমার সব সময় ঢাকা থাকা করুণতম বিষয়। আজ হঠাৎ আগল খুলে গেল।

আরডিকে যেমন স্বপ্নে পরিষ্কার দেখেন। বর্ষা ফিরে আসেন আপনার তন্দ্রায়?

(এ বার চোখের জল ফেটে পড়ার উপক্রম। কোনও রকমে সামলাচ্ছেন নিজেকে) আসে। আমি তো পরিষ্কার দেখতে পাই ওকে। এমনিতে ওর যে ঘর, সেটা অবিকল আগের মতো রেখে দেওয়া। ও চেয়েছিল ঘরটা রং হোক। রং করিয়ে দিয়েছি। প্রতি পনেরো দিন অন্তর ওর জামাকাপড়গুলো ধোওয়া হয়। শাড়ি টিপটপ লন্ড্রিতে যায়। ওর সব পারফিউম একদম গুছিয়ে রেখে দেওয়া। আজও মুম্বইতে থাকার সময় আমি বর্ষার ঘরে গিয়ে ওর বিছানায় বসি। ওর হাসিমুখ ভরা ছবির দিকে তাকিয়ে মা-মেয়েতে কথা বলি। বলি, আভি যা রহি হুঁ। ফির ওয়াপস আ জায়ুঙ্গি। তুই চিন্তা করিস না।

আমি জানি উপরে বর্ষা আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। গেলেই প্রথমে আমাদের দেখা হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

asha bhosle gautam bhattacharya interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE