তিন, শমিতাভ
স্যর আরও একবার বাঙালি পরিচালকের ছবিতে। এত দিনে সবাই জেনে গিয়েছে কার ছবিতে। পরিচালক আমার বন্ধু টোনি (অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী)। টোনির প্রথম হিন্দি ছবি। প্রোডিউসর আমি।
এ বারের ছবি সোশ্যাল থ্রিলার। দিল্লিতে শ্যুট। ‘পিকু’র মতো এখানেও সামাজিক বার্তা থাকবে। ফেব্রুয়ারিতে শ্যুটিং শুরু। স্যর যেন এখন বাঙালিয়ানা আরও বেশি চাইছেন।
এ ক’বছর তাঁর সান্নিধ্যে এসে দেখেছি, কেরিয়ারের এই পর্যায়ে স্যর কাজগুলো খুব উপভোগ করে করছেন। বলিউডে উনি যখন ফুল ফর্মে, তখন অনেক চাপ থাকত ওঁর ওপর। কোনও রকম ঝুঁকি নেওয়া যেত না।
এখনও অবশ্য বক্স অফিসের চেয়ে উনি ছবির বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেন। কাজ করতে করতে কম বয়সে ফিরে যান। নিজের ছেলেবেলার গল্প বলতে থাকেন। যা যা করতে পারেননি, তাই হঠাৎ হঠাৎ আমাদের সকলকে চমকে দিয়ে করে বসেন।
এ বার যেমন কলকাতার অফিস পাড়ায় স্কুটার চালালেন। আমাকে বললেন, ‘‘স্কুটার চালিয়ে ফিরে গেলাম দিল্লির নস্ট্যালজিয়ায়। দিল্লিতে কলেজে এক সময় খুব স্কুটার চালাতাম।’’
‘শমিতাভ’ ছবিতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শ্যুট করেছিলেন স্যর। ওখানকার পরিবেশে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘এই বাড়ির অন্দরের নিস্তব্ধতায়, পেল্লাই বারান্দায় কোথাও যেন রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা যায়।’’ জাতীয় সঙ্গীতের মতোই ‘কহানি’র জন্য রেকর্ড করেছিলেন ‘একলা চলো রে’।
কলকাতায় এলে স্যরের খুব ভাল লাগে। আজও দেখি আর অবাক হই এই মানুষটা কেমন অনর্গল বাংলা বলতে পারেন। আসলে কলকাতা তাঁর কাছে শুধুমাত্র একটা শহর নয়। কলকাতা মানে আবেগ, ভালবাসা আর একরাশ স্মৃতি। তাই মাঝরাতে নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই তিনি বেরিয়ে পড়েন কলকাতার অলিগলিতে। বললেন, ‘‘কলকাতায় হোটেলে ফিরে নিজের জন্য সময় পাই। মুম্বইতে কোনও সময়ই থাকে না। সারাক্ষণই কিছু না কিছু ঘটছে।’’ আমি স্যরকে বলেছি মাঝে মধ্যে আরামের জন্য, আনন্দের জন্য আমাদের শহরে চলে আসবেন।
মিস্টার বচ্চনকে দেখে এখনও অভিভূত হতে হয়। কী ভাবে নিজেকে মেনটেন করেন। বিশেষ করে ওঁর ব্যারিটোন ভয়েস— তিরিশেও যা, বাহাত্তরেও তাই। রিমার্কেবল ব্যাপার। বয়স হলে তো গলার আওয়াজ বদলে যায়, নানা রকম বিকৃতি হয়, অথচ ওঁর একই রকম। গলা ঠিক রাখার বিষয়ে উনি অবশ্য খুবই সচেতন। গলার জন্য নানা রকম এক্সারসাইজও করেন। গলা ছেড়ে গানও গান। আমি এইটুকুই জানি। এই রকম গলা রাখার পুরো রহস্যটা যে কী, সেটা অবশ্য আমি জানি না।
বাঙালিদের সঙ্গে স্যরের বরাবরই ভাল সম্পর্ক। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্তের সঙ্গে তো কাজ করেইছেন। অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’য়েও। শুনেছি রবি ঘোষের সঙ্গেও দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। কলকাতায় এলেই দেখা করতেন রবিদার সঙ্গে। দু’জনে ঘুরেও বেড়াতেন কলকাতার রাস্তায়। এমনকী রবিদার সঙ্গের সেই সব মুহূর্ত, অভিজ্ঞতা ‘পিকু’র ভাস্কর ব্যানার্জি চরিত্রের মধ্যেও ছিল।
এখন আমাকে, সুজয়কে খুব ভালবাসেন। নিয়মিত আড্ডা হয় আমাদের। আমার মনে হয় বাঙালি রুচির, সংস্কৃতির অনুরাগী স্যার। ইচ্ছে থাকলেও আগে এই ভাল লাগা তাঁর কাজে আনতে পারতেন না। এক সময় কমার্শিয়াল হিন্দি ছবিতে বাঙালির সূক্ষ্মতা দেখাবার জায়গা ছিল না।
অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী: বচ্চনের নতুন বাঙালি পরিচালক
স্যর এখন যে ছবি করছেন সেখানে বিষয় তো জোরালোই, তার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির হারিয়ে যাওয়া সূক্ষ্মতাও ফিরে আসছে। ষাটের দশকে মিস্টার বচ্চন যখন কলকাতায় ছিলেন, তখন ঘরে ঘরে যে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ব্যক্তিগত ভাবে স্যরও ইন্ডিয়ান ক্লাসিকালের ভক্ত। আমার মনে আছে ‘পিকু’তে সেতার বাজানোর দৃশ্যে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বলেছেন, ‘‘টোনির এই ছবিতেও ব্যাকগ্রাউন্ডে পুরো ক্লাসিকাল মিউজিক চালাবি।’’
স্যরের হয়তো আমার ওপর একটা বিশ্বাস জন্মেছে—সুজিত যা তা স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসবে না।
কোথাও জীবনের এই পর্যায়ে উনি সূক্ষ্মতা খোঁজেন। সেই সূক্ষ্মতা যা মুম্বইয়ের সমান্তরাল ছবিতে তিনি বোঝাতে পারেননি। আজকের বাঙালি ছবির সূক্ষ্ম অনুভূতির সঙ্গে কোথাও যেন মিলে যাচ্ছে।
স্যর আরও যেন বাঙালি হয়ে উঠছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy