Advertisement
০৯ মে ২০২৪

মেঘ কালো, তার চেয়েও কালো বলিউড

তেমনই নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল প্রত্যুষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু কী করলে এই আবহাওয়াতেও লড়াই করা যায়? জীবন শেষ হয় না আত্মহত্যায়। লিখছেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বই শহর কারও নিজের নয়।এ শহর কাউকে চেনে না। এ শহর ফিরিয়ে হয়তো দেয় না। কিন্তু কাউকে আপনও করতে পারে না।মুম্বইয়ে বাঙালিদের কাজ করা প্রসঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, ‘‘বাঙালিরা কলকাতার বাইরে গিয়েও বাংলাকে খোঁজে।’’

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৩
Share: Save:

পাঁচ মাস মুম্বইয়ে কোনও কাজ ছিল না। একা একা উইন্ডো শপিং করতাম — ইন্দ্রাণী হালদার

মুম্বইতে কেউ চিনত না আমায়। নিজেকেই নিজের বাড়ি খুঁজতে হয়েছে। গ্যাসের বিল থেকে ফোন কানেকশানের জন্য ছোটাছুটি করতে হয়েছে। হুট করে গাড়ি কেনার পয়সা ছিল না। কলকাতা থেকে গাড়ি আনাতে হয়েছিল — পাওলি

মুম্বই একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। কেবলই কাজের পেছনে ছোটা। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একদিন মনে হল আমি কত একা — ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

মুম্বই শহর কারও নিজের নয়।

এ শহর কাউকে চেনে না। এ শহর ফিরিয়ে হয়তো দেয় না। কিন্তু কাউকে আপনও করতে পারে না।

মুম্বইয়ে বাঙালিদের কাজ করা প্রসঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, ‘‘বাঙালিরা কলকাতার বাইরে গিয়েও বাংলাকে খোঁজে।’’

সেই কোন ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিলেন প্রত্যুষা। সুস্মিতা সেনের মতো হবেন তিনি। তাঁর চুল বাঁধার স্টাইলটাও রপ্ত করে নিয়েছিলেন। স্কুল থেকেই নাটকে অভিনয়, রোড শো করতেন। তাঁর স্বপ্ন তাঁকে নিয়ে গেল মুম্বই। কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে ‘বালিকা বধূ’র ‘আনন্দী’ ছাড়া তাঁর কোনও নিজস্ব ‘আইডেনটিটি’ তৈরি হল না।

হত্যা না আত্মহত্যা? প্রত্যুষার পরিবারবর্গ যদিও মনে করছেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। রহস্য আরও ঘনাচ্ছে...

মুম্বইয়ে ট্যালেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ।

“মুম্বইতে নতুন করে নিজেকে চেনাতে হয়। আগের কাজের সূত্র ধরে কিছু যাচাই করা হয় না। এটা আসলে গতিসম্পন্ন টি টোয়েন্টি খেলা। সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নয়তো কেউ মনে রাখবে না,’’ বলছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

মুম্বইয়ে এই হারিয়ে যাওয়ার ভয়েই বেশির ভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রী আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগেন। নবাগতেরা অনেক সময় বুঝেই উঠতে পারেন না কাজ পাওয়ার জন্য ইন্ডাস্ট্রির দরজায় দরজায় ঘোরার টেকনিকটা কী? তাঁরা সহজেই হতাশায় ভুগতে আরম্ভ করেন।

নতুন শহরের সঙ্গে নয়। নতুন মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই প্রেম হয়ে যায় মুম্বইয়ে। প্রেমিক যত তাড়াতাড়ি জোটে কাজ তত তাড়াতাড়ি জোটে না। কাজের বদলে কাছের মানুষকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় তখন নতুন প্রজন্ম। বন্ধুকে প্রেমিক বলে ভুল হয়।

যেমন প্রত্যুষা। রাহুলকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকেই তাঁকে বিয়ের আগে মাথায় সিঁদুর পরতে দেখেছেন। কাজ নয়, বিয়ের জন্যই নাকি পাগল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অসম্ভব এক নিরাপত্তাহীনতা ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। সন্তান আসার কথা ভেবেই কি এতটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন প্রত্যুষা? কে জানে আরও কত প্রত্যুষা ছড়িয়ে আছেন মুম্বইয়ের ফিল্ম সিটি, মাড আইল্যান্ডের বাংলো বা সংক্রমণ স্টুডিয়োর সিরিয়াল পাড়ায়!

মুম্বইয়ের নাইটলাইফের চোখ ধাঁধানো আলোতেও অন্ধকার নেমে আসে অনেকের জীবনে। রাত–পার্টি আর ড্রাগসের নেশায় ভেসে যায় জীবন। কী আর করা? দ্রুত রোগা হওয়ার পাগলামিতে অনেক তাবড় তাবড় সুন্দরীও ড্রাগের নেশায় মত্ত।

অনেকের মনে হয় নতুন প্রজন্ম খুব বেশি অস্থির। টাকাকড়ি, গাড়ি, বাড়ি, বয়ফ্রেন্ড দ্রুত চাই তাঁদের। ‘‘আমার মনে হয় কারও কাছে জবাবদিহি করাটা জরুরি। আমি কী করছি, কেন করছি? মুম্বইয়ে কাজ করতে এসে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হযে যায় সবাই। এটাই মারাত্মক। এখান থেকেই একাকীত্বের জন্ম,’’ শ্যুটিং ফ্লোর থেকে বললেন ঋতুপর্ণা।

সাফল্য আর খ্যাতির হাত ধরেই তো আসে অবসাদ।

প্রথম যখন অভিনয় করতে এলেন, তখন টলি বা বলি কোনও ইন্ডাস্ট্রিতেই কোনও পরিচয় ছিল না পাওলির। অথচ আজ কলকাতার চেয়ে মুম্বইতেই তাঁর বন্ধুবান্ধব বেশি। শ্যুট না থাকলে মুম্বইতে থাকতে চান পাওলি। ‘মহানায়িকা’র সিরিয়ালের জন্য দার্জিলিংয়ে শ্যুট করতে করতে বললেন, ‘‘প্রথম মুম্বইতে গিয়ে আমাকেও প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়েছে। তবে স্ট্রাগল না করলে জীবনে বড় হওয়া যায় না। নিজেই নিজের বাড়ি খুঁজেছি। কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। অনেক দিন মুম্বইতে কোনও কাজ ছিল না। তখন জায়গাটা এক্সপ্লোর করেছি। পৃথ্বী থিয়েটারে নাটক দেখেছি। নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আরে, সম্পর্ক না থাকলে না থাকবে। নতুন সম্পর্ক আবার আসবে। তার জন্য মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হবে কেন? আমার আর্ট ডিজাইনার বন্ধু দিব্যি আছে মুম্বইতে একা। মন খারাপ হলে মাউন্টেনিয়ারিং করে।’’

‘মা শক্তি’ থেকে ‘মর্যাদা’—মুম্বইয়ের সিরিয়াল ফ্লোরে একটানা অভিনয় করে এসেছেন ইন্দ্রাণী হালদার। প্রত্যুষার কথা উঠতেই ‘গোয়েন্দা গিন্নি’র ফ্লোর থেকে বললেন, ‘‘খুব খারাপ লাগছে প্রত্যুষার কথা জেনে।’’ কুড়ি থেকে বাইশ ঘণ্টা কাজ করেছেন ইন্দ্রাণী সিরিয়াল করতে গিয়ে। বলছেন বেশির ভাগ সময় বাড়ি ফেরাই হত না তাঁর। কলকাতায় স্টুডিয়োপাড়ায় মাসের দ্বিতীয় শনিবার ছুটির রেওয়াজ থাকলেও মুম্বইয়ে ওসবের বালাই নেই। দিন রাত টানা কাজ করে শরীররটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ইন্দ্রাণী ফিরলেন নিজের শহরে। তবে মুম্বইতে যে সব অভিনেত্রী অন্য শহর থেকে গিয়ে লাগাতার কাজ করছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে সোজাসুজি বললেন, ‘‘মুম্বইতে একাই থাকতাম। তখন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে প্রচুর পার্টিও করেছি। কিন্তু লাগামছাড়া কিছু করিনি কখনও।’’

আসলে মুম্বইয়ে সিরিয়াল করা অনেকটা কল সেন্টারের কাজের মতো। দিন রাতের ঠিকঠিকানা নেই। বলছিলেন একটানা মুম্বইয়ে সিরিয়াল করা বিক্রম।

এক সময় প্রত্যুষাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘একটা সম্পর্কের জন্য নিজের জীবন শেষ করে দিল ও। ভাবতে পারছি না।’’ মুম্বইয়ের একটি চ্যানেলের জন্য সিরিয়ালে অভিনয় করছেন ত্রিধা চৌধুরী। মুম্বইয়ে বসেই বললেন, ‘‘প্রত্যুষার ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। মুম্বইয়ে কাজ করতে আসা মানেই কাজ না পেলেও ধৈর্য ধরে থাকা। মাঝে মাঝে হতাশায় ভোগা। একগুচ্ছ ট্যালেন্টের সঙ্গে একার লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এবং এত কিছুর পরেও কোনও ভাবেই নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে না ফেলা।’’ ত্রিধা মনে করেন তিনি সবেমাত্র মুম্বই যাত্রা শুরু করেছেন। এখনও অনেক ধৈর্য ধরতে হবে তাঁকে।

একটানা কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে মুম্বইতে হঠাৎই শিল্পীরা একা হয়ে যান। বেশির ভাগই পাগলের মতো বন্ধু খুঁজতে থাকেন। আর বন্ধু জুটলেও সেটা আসে কাজের জায়গা থেকেই। পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে আসে প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা। প্রত্যুষাও কি সে ভাবেই বন্ধু খুঁজে রাহুলের সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন?

আরও পড়ুন-বাঁচতে হলে

‘‘ছোট শহর থেকে বড় শহরে গ্ল্যামারের আলোয় যখন কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রী আসেন, তখন আজকের জীবনের সঙ্গে আগের বেড়ে ওঠা জীবনের বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। বিনোদনের জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তিত্বরা বুঝতেই পারেন না কী ভাবে চূড়ান্ত মানসিক চাপ হ্যান্ডেল করবেন? ক্যামেরার বাইরেও তাঁরা ক্যামেরাবন্দি ইমেজ নিয়ে বেঁচে থাকেন। তাই কোনও বন্ধুকেও সেলিব্রিটি হিসেবে নিজের সমস্যা বলতে ভয় পান। আরও একা হয়ে পড়েন তাঁরা,’’ বললেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্ধু নয়, আরও অন্ধকারে হাত বাড়িয়েছিলেন প্রত্যুষাও।

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত থেকে ইন্দ্রাণী হালদার। প্রত্যেক অভিনেত্রীর জীবনেই কিন্তু ফ্রাসট্রেশন এসেছে। ইন্দ্রাণী বললেন, ‘‘‘মর্যাদা’ সিরিয়ালের পরও আমাকে পাঁচ মাস মুম্বইতে বসে থাকতে হয়েছিল। পরের সিরিয়ালের জন্য ওই প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছিল আমি অন্য কোথাও কাজ করতে পারব না। পাগল-পাগল লাগত। তখন একাই ঘুরে বেরিয়েছি। একা একা সিনেমা দেখেছি। লোখান্ডওয়ালায় উইন্ডো শপিং করেছি। কী করব? মুম্বই যা এক্সপেনসিভ! গাড়ি-বাড়ি-ড্রাইভার...’’

অবসাদ অতিক্রম করার মধ্যেই টিকে থাকার সাফল্য লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন ঋতুপর্ণা।

কাজের টানেই ৯৬ সালে মুম্বই যেতে হয়েছিল চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়কে। তখন সোপ সিরিয়ালের নতুন জমানা। বালাজি ফিল্মসের একতা কপূরের অনুরোধে তিনি প্রতি সপ্তাহে কলকাতা-মুম্বই যাতায়াত করতেন।
‘‘ধৈর্য ধরতে হবে। প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের কাজের খিদেটা জিইয়ে রাখতে হবে। কষ্ট হলেও সেটাকে মানিয়ে নিয়েই কাজ করতে হবে,’’ বললেন চূর্ণী।

কখনও কাজের জন্য হন্যে হয়ে স্টুডিয়োপাড়ায় ঘোরা। কখনও বা ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ বন্ধুহীন, কখনও বা নেশার সঙ্গে অন্ধকারে ডুব। কখনও বা ক্যামেরার ফ্ল্যাশে রাতের তারার স্বপ্ন ছোঁওয়া। সব মিলিয়ে মুম্বই — এক মায়ানগরী। এই মায়ার বলয় পেরোতে না পারলে বলিউড যেন অনেক বেশি কালো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bollywood Pratyusha Banerjee mumbai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE