Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মান্নার উ

মান্নাদা বলতেন আমেরিকা দু’-তিন মাসের জন্যই ভাল, তার বেশি নয়

লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমুম্বই শহরে মান্নাদার বাড়ি ‘আনন্দন’-এর কথা অনেকে শুনেছেন, অনেকে বাইরে থেকে দেখেছেন, যারা খুব ভাগ্যবান তারা এই বাড়ির ভিতরে যেতে পেরেছেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না এই ‘আনন্দন’য়েও একটা কমপিউটার সেন্টার ছিল—দে’জ সফটওয়্যার।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ২২:২৯
Share: Save:

মুম্বই শহরে মান্নাদার বাড়ি ‘আনন্দন’-এর কথা অনেকে শুনেছেন, অনেকে বাইরে থেকে দেখেছেন, যারা খুব ভাগ্যবান তারা এই বাড়ির ভিতরে যেতে পেরেছেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না এই ‘আনন্দন’য়েও একটা কমপিউটার সেন্টার ছিল—দে’জ সফটওয়্যার। সে আজকের কথা নয়। আশির দশক। ভারতবর্ষে তখনও কমপিউটরের তেমন প্রচলন হয়নি। কিন্তু মান্নাদা এবং তার পরিবার সর্বদা সময় থেকে অনেক এগিয়ে থাকতেন। জুহু স্কিমে মান্নাদার বাড়ি খুবই অভিজাত এলাকায়। ছোট মেয়ে সুমিতা যখন বলল সে একটা কমপিউটর শিক্ষার স্কুল খুলতে চায়, তখন মান্নাদা প্রবল উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘‘হোয়াই আর ইউ লুকিং ফর সাম আদার প্লেস, হোয়েন ইউ হ্যাভ সাচ এ বিগ হাউস হেয়ার।’’ মান্নাদা নিজেই বাড়ির পিছন দিকের দুটি ঘর আইডেন্টিফাই করলেন। বললেন, ‘‘বাইরের ছেলেমেয়েরা শিখতে আসবে, ঘরগুলোকে ভালভাবে সাজাতে হবে।’’ যা বলা তাই কাজ। তিরিশ বছর আগে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে কমপিউটর ঘর দুটোকে সাজানো হল। দুটো কমপিউটর কেনা হল প্রায় ৯০ হাজার টাকায়। এই নিয়েও মান্নাদার সমান উৎসাহ। তখন আশেপাশে এ ধরনের শিক্ষাকেন্দ্র বিশেষ ছিল না। কাছেই মুম্বইয়ের মিঠিভাই কলেজ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্র্যাকটিকাল ক্লাস করতে আসত ‘আনন্দন’য়ের দে’জ সফটওয়্যার-এ। মান্নাদা খবর নিতেন, সব ঠিকঠাক চলছে তো?

মুম্বইয়ের দীর্ঘদিনের বাস ছেড়ে মান্নাদা বেঙ্গালুরু চলে গেলেন দু’হাজার সাল নাগাদ, পরোক্ষে তার কারণও ছিল কিন্তু কমপিউটর। ব্যাপারটা এই রকম। তখন মান্নাদা হিন্দি ছবিতে গান গাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। আশির কাছাকাছি বয়স। পেশাগত কারণে মুম্বই থাকারও তেমন প্রয়োজন নেই। একটাই টান। ছোট মেয়ে ও জামাই। থাকে লোখন্ডওয়ালা কমপ্লেক্সে। মান্নাদার বাড়ি থেকে গাড়িতে পনেরো মিনিটের দূরত্ব। রোজ নিজে গাড়ি চালিয়ে মেয়ের বাড়ি একবার যাবেনই মান্নাদা। বড় মেয়ে সুরমা তো বহু দিন আমেরিকায়। শেষ দিককার কমপিউটর নিয়ে পড়াশোনা, চাকরি এবং বকুল হেরকরের সঙ্গে বিয়ে। সবই আমেরিকাতে। ওখানেই সেটেলড তখন। এ দিকে ছোট মেয়ে ও জামাই তাদের কমপিউটর ব্যবসাগত কারণে মুম্বই থেকে বেঙ্গালুরু শিফট করার কথা ভাবছে। বিভিন্ন এডুকেশন সফটওয়্যার তৈরির ব্যবসা তাদের। ডিসিপিএল কোম্পানির সঙ্গে অ্যালায়েন্স। কলকাতার ‘চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল’-এ তাদের হেড অফিস। এই এডুকেশন সফটওয়্যারের প্রচুর গ্রাহক তখন মুম্বই ছেড়ে বেঙ্গালুরুতে শিফট করছে। ভারতের আইটি মানচিত্রে বেঙ্গালুরু তখন নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। মুম্বই থেকে ব্যবসা কনট্রোল করা তখন প্রায় অসম্ভব। অতএব ১৯৯৪ সাল নাগাদ ছোট মেয়ে ও জামাই লোখন্ডওয়ালার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে সেটলড করলেন। মান্নাদা তখন কিছুতেই ওদের সঙ্গে যেতে চাইলেন না। নিজের এত বড় খোলামেলা বাড়ি। এই শহরে ৫৫ বছরের বসবাস। বললেই কি আর যাওয়া যায়? মেয়ে-জামাইকে বললেন, ‘‘তোমাদের প্রায় সব ক্লায়েন্ট বেঙ্গালুরু চলে গেছে। এখান থেকে কী করে ম্যানেজ করবে? তোমরা যদি বেঙ্গালুরুতে সেটলড করতে চাও, আমার কোনও আপত্তি নেই। এখানে তোমাদের তো প্রায়ই আসতে হবে। কিছু ক্লায়েন্ট তো এখনও কিছু দিন এখানে থাকবে। তা ছাড়া আমরাও তো আছি।’’ মান্নাদার জীবনের একটা বড় ঘটনা এই সময় ঘটল। ১৯৯৪ সালে ছোট মেয়ে ও জামাই লোখন্ডওয়ালার বাড়ি বিক্রি করে চলে এল বেঙ্গালুরু।

প্রথম প্রথম সব কিছু ঠিকমতোই চলছিল। মান্নাদা হিন্দি ছবিতে কাজ করা অনেক কমিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠানগুলো তো আছে। বছরে টানা দু’মাস তো আমেরিকায় থাকবেনই। নতুন নতুন বাংলা গানের রেকর্ডিং আছে। বেশ কিছু দিন ধরে মান্নাদার মনে হতে লাগল একা একা মুম্বইতে আর ভাল লাগছে না। সন্তানরা কেউ কাছে নেই। দীর্ঘদিনের সহকর্মী-বন্ধু একে একে প্রায় সকলেই চলে গিয়েছেন। একা একা আর ভাল লাগে না। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এত বড় বাড়ি, বিশাল বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ করা আস্তে আস্তে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। মান্নাদা সিদ্ধান্ত নিলেন মুম্বই ত্যাগ করবেন। কিন্তু যাবেন কোথায়?

মান্নাদার কাছে তখন তিনটি অপশন। কলকাতা, আমেরিকা, বেঙ্গালুরু। মান্নাদা সত্যিই আন্তরিক ভাবে কলকাতায় একটা বাড়ি খুঁজছিলেন। তাঁর পছন্দের জায়গা ছিল সল্টলেক। দূষণটা কম, একটু ফাঁকা ফাঁকা। শেষ পর্যন্ত পছন্দসই কোনও বাড়ি মান্নাদা এখানে পেলেন না। একটু খোলামেলা থাকতে পছন্দ করতেন মান্নাদা। মদন ঘোষ লেনের পৈতৃক বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে থাকা খুবই অসুবিধা। একতলায় মান্নাদার ঘর মাত্র একটা। যদিও বেশ বড়। দক্ষিণমুখো ঘরের সামনে ছোট্ট বারান্দা। ঘরে একটি বড় ও একটি ছোট খাট। দুটো টেবিল। দুটো স্টিলের আলমারি। কয়েকটা কাঠের আলমারি। একটা আলমারির দু’পাল্লায় দুটি আয়না। ঘরের মেঝেয় হাল্কা সবুজ ম্যাট পাতা। মান্নাদা যখনই যে কাজে এসেছেন, থাকতেন মদন ঘোষ লেনের বাড়ির এই ঘরে। কিন্তু ম্যাডামকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে এখানে থাকা এই বয়সে সত্যি অসম্ভব। অ্যাটাচড ওয়াশরুমও নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য কলকাতায় মান্নাদার জন্য সঠিক বাড়ির ব্যবস্থা করা গেল না। দ্বিতীয় চিন্তায় আমেরিকা। সানফ্রান্সিসকো শহরে। বড় মেয়ে সুরমার কাছে। মান্নাদার বড় আদরের ‘রামি’ অর্থাৎ সুরমা বাবাকে বারবার বলছে—‘‘অনেক গান করেছ সারা জীবনে। এখন তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। তুমি আমার কাছে পাকাপাকি ভাবে চলে এসো।’’

এক সময় মান্নাদা সেরকমও ভেবেছিলেন। আনন্দবাজারে রূপায়ণ ভট্টাচার্য এই নিয়ে লিখেছিল—‘‘অভিমানে চলে যেয়ো না’’। যদিও আমেরিকা মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় দেশ, ওখানে তাঁর প্রচুর ভক্ত, তাঁর প্রিয় কন্যা সেখানে। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে সেখানে চলে যেতে মন সায় দিল না। মান্নাদা বলতেন, ‘‘আমেরিকা দু’তিন মাসের জন্যই ভাল, এই যেমন প্রতিবছর যাই। রমা-বকুলের সঙ্গে দেখা হয়। অনুষ্ঠানও হয়। ভালই সময় কাটে। তবে সব কিছু ছেড়ে ওখানে সেটল করা মুশকিল।’’

অতএব পড়ে রইল শেষ অপশন বেঙ্গালুরু। মান্নাদার মনে হল বেঙ্গালুরু গিয়ে সেটল করলে সব দিক দিয়ে ভাল হয়। মুম্বইয়ের বাড়িও আস্তে আস্তে পুরোনো হয়ে আসছে। অত বড় বাড়ি। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হাতির খরচ। এই বাড়ি বিক্রি করে বেঙ্গালুরুতে কিছু করা যায়। তাতে ক্যাপিটাল গেন ট্যাক্সও অনেক বাঁচে। বেঙ্গালুরুতে থাকলে প্রতিবছর আমেরিকায় দু’তিন মাস করে থাকা কোনও অসুবিধার নয়। চারদিকে নিয়মিত যে অনুষ্ঠান, রেকর্ডিং সবই আগের মতো করা যাবে। অতএব বাড়ির জন্য খরিদ্দার দেখা শুরু হল। সেই বাড়ি কিনলেন বোম্বের এক ডায়মন্ড মার্চেন্ট। মান্নাদা খুব দুঃখ করতেন, ভদ্রলোক অযথা নিজের থেকে একটা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আনন্দন’ চিরদিন একই ভাবে থাকবে। কিন্তু বাড়িটা কেনার পর ভদ্রলোক অচিরেই সেই বাড়ি ভেঙে এক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি করেন।

২০০০ সালে মান্নাদা চলে এলেন বেঙ্গালুরুর কোরামন্ডলায়। এক নতুন জীবনের শুরু। সুমিতার বাড়িতে সবাই একসঙ্গে। এখানে মান্নাদা ছিলেন দু’বছর। জামাইয়ের কমপিউটর ব্যবসাকেন্দ্র মূলত ইয়ালংকায়। কোরামন্ডলা থেকে যেতে-আসতে চার-পাঁচ ঘণ্টা। কাছাকাছি হয় কল্যাণনগর। সবার মতে, সেই সময়ে এশিয়ার বেস্ট রেসিডেন্সিয়াল লে-আউট। এখানেই কাছাকাছি দুটো বাড়ি নেওয়া হল। মান্নাদা ফার্স্ট ফ্লোরে। সব কিছু ঠিক ছিল। ‘আনন্দন’-এ যেমন ‘দে’জ সফ্টওয়্যার’ খুলতে মান্নাদা খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন, ২০০২ সালে এই কল্যাণনগরে যখন মেয়ে-জামাই ‘ফুড মার্ট’ শুরু করেন, মান্নাদার উৎসাহ ছিল দেখার মতো। যত দিন শরীর দিয়েছে বেঙ্গালুরু থাকলে মান্নাদা রোজ একবার সেখানে যেতেনই। অনেক বিদেশি ছেলেমেয়ে, মূলত স্টুডেন্ট, সেখানে পার্টটাইম কাজ করত। এটাও মান্নাদার কাছে একটা গর্বের বিষয় ছিল। ওদিকে তাঁর কোমরের ব্যথাটাও ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে বেশ কষ্ট হয়। আরও কিছু কারণ ছিল। তাই নতুন বাড়ির খোঁজ শুরু হল। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি বাড়ি তাঁর পছন্দ হল। নাম—‘ঋতুগোকুলম’। এই বাড়িটাই মান্নাদার শেষ ঠিকানা।

১৯১৯ সালের পয়লা মে মান্নাদা এসেছিলেন মদন ঘোষ লেনের ঠিকানায়। তারপর চল্লিশ দশকের প্রথমেই কাকার হাত ধরে বোম্বের ঠিকানায়। এখান থেকে ওখানে। লোনাভালার বাংলো। তারপর কোরামন্ডলা, কল্যাণনগরের ঋতুগোকুলম। মান্নাদার জীবনে ঠিকানা বদলেছে বারবার। কিন্তু সুরের খামে গানের যে-বাণী তিনি ‘পোস্ট’ করেছেন সারা জীবন ধরে, তার সবই পৌঁছে গেছে মানুষের ভাললাগার ঠিকানায়। সযত্নে সঞ্চিত সেগুলি। বর্তমানের গর্ব। পরম্পরায় এ এক অমূল্য উত্তরাধিকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE